ষাটের দশকের একজন তরুণকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলতেন- তিনি স্বাধীন দেশ দেখতে চান। সত্তর দশকের একজন তরুণ বলতেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ যেন পুনর্গঠিত হয় সেটাই তিনি চান। আশির দশকের তরুণ বলতেন, তিনি স্বৈরাচার মুক্ত দেশ চান। নব্বই দশকের তরুণ বলতেন, তিনি গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা দেখতে চান।
আজকের তরুণরা কী চায়?
অবশ্যই গণতন্ত্র চায়। ভোটাধিকার চায়। মানবাধিকার চায়। মতপ্রকাশের অধিকার চায়। কাজ চায়। কিন্তু আজ থেকে ২৫ বছর আগে এ প্রশ্নের উত্তরে তরুণরা যেভাবে কথা বলতো, আজকের তরুণ সেভাবে কথা বলবে না।
তাদের উত্তর পাল্টে গেছে। কেন পাল্টে গেছে?
কারণ, ২৫ বছর আগে পৃথিবীর দেশগুলো বিশ্বায়নের আওতার মধ্যে আসেনি। বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের মধ্যে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের অবাধ ব্যবস্থা তৈরি হয়নি। ইন্টারনেট মাধ্যম আজকের মতো সুলভ হয়নি। আজকের একজন তরুণ বা তরুণী যেভাবে বৈশ্বিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থার মধ্যে সহজে নিজের অবস্থান তৈরি করতে পারে, সেটা ২৫ বছর আগে প্রায় অসম্ভব ছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা সুইডেন দেশগুলো কেমন, দেশগুলো কীভাবে পরিচালিত হয় তা দেখার জন্য বইপত্রের সীমিত উৎসের ওপর একজন তরুণকে নির্ভর করতে হতো। নয়তো, বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত হিসেবে যারা সেসব দেশে যাবার সুযোগ পেত, তাদের কাছে শুনে নিতে হতো।
কিন্তু আজ সে বাধা নেই। ইন্টারনেট মাধ্যম তরুণদের তথ্য পাওয়ার ব্যবস্থাকে এমনভাবে উন্মুক্ত করে দিয়েছে যে, না চাইলেও দেশের বাইরে খবর, ছবি, ভিডিও তাদের কাছে চলে আসে। শুধু বড় বড় ঘটনার অডিও-ভিজ্যুয়াল সংবাদ নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে সেসব দেশের মানুষের জীবন-যাপনের বিস্তারিতও তাদের কাছে সহজে ধরা দেয়। আগের চেয়ে বিবিসি, সিএনএন, আল জাজিরা বা ডয়েছে ভেলে-এসব আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমও অনেক বেশি সহজলভ্য।
আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি, তারা যখন ভবিষ্যতের বাংলাদেশ নিয়ে ভাবতে থাকে তখন এই তথ্যগুলো তাদের সামনে নতুন এক কল্পনা নিয়ে হাজির হয়। মনের গভীরে তৈরি হওয়া সেই বাংলাদেশের রূপকল্প কেমন, তা তারা সব সময় গুছিয়ে বলতে না পারলেও সেই বাংলাদেশের ছবিটা কেমন তা আমরা বুঝতে পারি। অনেক সময়ই তারা বুঝিয়ে দিতে পারে, তারা কেমন বাংলাদেশ চায়। তারা বড় ধরনের রূপান্তর চায়।
গত কয়েক বছরে তরুণদের মাধ্যমে সংগঠিত কয়েকটি আন্দোলনের কথা ভাবলেই বোঝা যেতে পারে। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া কিশোরদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে তাদের দাবিগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায় তারা কী চায় এবং কোথা থেকে শিখেছে। সে সময় নিজেদের উদ্যোগে সড়কে তারা যে নিয়মগুলো প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে, সেগুলো যে কোনো উন্নত দেশের সড়ক ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনীয়। তারা বুঝেছে, সড়কগুলো শাসন ব্যবস্থা থেকে আলাদা কিছু নয়। সড়ক ঠিক করতে হলে রাষ্ট্র ব্যবস্থা ঠিক করতে হবে। রাষ্ট্র মেরামত করতে হবে। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে। কিশোর-কিশোরীরা এই গভীর শিক্ষা কোথা থেকে পেল? আমরা যারা ভেবেছিলাম, দেশে শুধু রাজনীতিবিমুখ প্রজন্মই তৈরি হচ্ছে, দেশ নিয়ে রাজনীতি নিয়ে এখনকার তরুণদের চিন্তা-ভাবনা নেই তাদের কীভাবে সড়ক আন্দোলন ভুল প্রমাণ করতে পারলো?
শুধু নিরাপদ সড়ক আন্দোলন নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক কোটা সংস্কার আন্দোলনও কিন্তু আমাদের চোখ খুলে দিয়েছিল। সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন কীভাবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল সেটি আমরা দেখেছি। এমনকি যাদের একসময় সবচেয়ে রাজনীতিবিমুখ হিসেবে চিহ্নিত করা হতো সেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ধিত ফি নিয়ে আন্দোলন শুরু করলো তখনও তাদের দেয়াল লিখনে, স্লোগানে, কথায় আমরা রাজনীতি সচেতনতা দেখতে পেলাম।
এ তিনটি আন্দোলনসহ তরুণদের বিভিন্ন তৎপরতায় আমরা খুবই স্পষ্টভাবে বুঝতে পারলাম, এখনকার তরুণরা নিরপত্তা, নীতি, ন্যায়, সমতাভিত্তিক সমাজ নির্মাণ করতে চায়। তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা তীব্র। তাদের মনে দেশের একটা রূপকল্প খুব স্পষ্টভাবে আঁকা আছে। এটা বিস্ময়কর একটি অভিজ্ঞতা। কেননা এই তরুণরা ষাটের দশকের উত্তাল সময়ের তরুণদের মতো বামপন্থী আদর্শে দীক্ষিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। ছাত্র আন্দোলনের তুঙ্গস্পর্শী সময়ে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের রাষ্ট্র-সমাজ সম্পর্কে শিক্ষিত ও রাজনীতি সচেতন করে তোলেনি। আশি-নব্বই দশকের মতো ছাত্র আন্দোলনের তীব্র সময়ে তারা বেড়ে ওঠেনি। বরং, রাজনীতি থেকে নানাভাবে তাদের বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে। তাদের মধ্যে রাজনীতির এই প্রয়োজনীয় শিক্ষা কীভাবে ঢুকলো?
আমার কাছে উত্তর একটাই। এই তরুণরা আমাদের সময়ের মতো তরুণ নয়। তারা আরও অগ্রসর। তারা শারীরিকভাবে দেশে থাকলেও মানসিকভাবে একটি বৈশ্বিক সমাজের বাসিন্দা। গণতান্ত্রিক বিশ্বের নাগরিকদের সঙ্গে তাদের কার্যকর যোগাযোগ আছে। তারা জানে, একটি রাষ্ট্রকে কেমন হতে হয়, দেশ কীভাবে পরিচালনা করতে হয়, ন্যায়বিচার কী, মানবাধিকার কী, সাম্য কী, মতপ্রকাশের অধিকার কী, নাগরিকদের নিরপত্তা কোথা থেকে আসে। এমনকি এসব প্রতিষ্ঠা করতে সংগঠিত হওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কেও তারা জানে, রাস্তায় নেমে দাবি জানাতেও জানে।
আজ যাদের বয়স ৫০-এর আশপাশে বা ৫০ পেরিয়ে গেছে তাদের মধ্যে বেশিরভাগই যা চলছে তাই মেনে নিয়েছেন। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। কিন্তু আগের প্রজন্মগুলো নতুন একটি দেশের রূপকল্প সহজে ভাবতে পারে না। দেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলার কল্পনা করতে পারে তরুণরাই। যাদের বয়স ৪০ এর নিচে তাদের মধ্যেই নতুন কিছু করার স্বপ্ন থাকে, নতুন কিছু প্রতিষ্ঠার জন্য লাফিয়ে পড়ার বাসনা থাকে, কল্পনা বাস্তবায়নের সাহস থাকে।
কিন্তু তারা কী চায় সে কথা শোনার ইচ্ছা কি নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আছে?
পেশাগত কারণে আমাকে অনেক তরুণের সঙ্গে কথা বলতে হয়, তাদের দুঃখ-বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন-কল্পনা সম্পর্কে আমি শুনি। খুব আগ্রহ নিয়েই শুনি। বুঝতে পারি, তরুণরা ভাল কিছু করতে চায়। পত্রপত্রিকাগুলোও মাঝে মাঝে তরুণদের প্রশ্ন করে জেনে নিতে চায়, তারা কেমন বাংলাদেশ চায়। কিন্তু যারা দেশ পরিচালনা করে, নীতি প্রণয়ন করেন, যারা ঠিক করেন আগামীর বাংলাদেশ কেমন হবে তারা কি তরুণদের কথা শোনেন? রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে তরুণদের নিয়ে অনেক গালভরা প্রতিশ্রুতি থাকে। কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়ন আমরা দেখতে পাই না। দেশে লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ তাই বেকার থেকে যায়, অদক্ষ তরুণরা বিদেশে গিয়ে অকূল পরিস্থিতিতে পড়ে, লক্ষ লক্ষ তরুণ ভাল থাকার আশায় বিদেশে পাড়ি জমায়, তারা দেশ নিয়ে হতাশায় ভোগে।
আমার মনে হয়, তরুণরা কেমন বাংলাদেশ চায় সেটি আমাদের নীতি-নির্ধারকরা জানেন না, জানতে চানও না। শাসন প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণের কোনো ব্যবস্থাও করতে চান না।
খুব ছোট একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। দেশে শেষ বারের মতো অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে ২০০৮ সালে। সে নির্বাচনে তরুণ-বয়স্ক নির্বিশেষে সকলেই ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পেরেছেন। কিন্তু ২০০৮ সালের পর কি দেশে ভোট হয়েছে?
এরপর দেশে দু’দুটি নির্বাচন হয়েছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন দুটি সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। দেশের মানুষ ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি সংসদে পাঠাতে পারেনি। দেশ গণতন্ত্র থেকে অগণতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার মধ্যে ঢুকে গেছে। এতে দেশের সব নাগরিকই কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে দেশে দুর্নীতি বেড়েছে, পাচার বেড়েছে, অনিশ্চয়তা বেড়েছে, দ্রব্যমূল্য চলে গেছে মানুষের হাতের নাগালের বাইরে।
কিন্তু এসবের সঙ্গে তরুণদের যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়। ২০০৮ সালের পর দেশে প্রায় ৩ কোটি ৭৫ লাখ তরুণ ভোটার হয়েছে। এই তরুণদের অধিকাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছর, এরা কখনোই ভোট দিতে পারেনি। এ কথাটা আমাদের দেশে অনেকেই জানেন। খুব সাধারণ একটি তথ্য হিসেবে এটি উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু এর তাৎপর্য কত গভীর সেটি নিয়ে নীতি-নির্ধারকরা কখনো ভেবেছেন বলে মনে হয় না।
কোটি কোটি তরুণ ভোট দিতে পারেনি মানে ভোটের আগে তাদের কাছে রাজনীতিকরা জিজ্ঞেস করেনি তারা কী চায়? কোন নীতি গ্রহণ করলে তাদের সুবিধা হবে, তারা স্বস্তি বোধ করবে। জানতে চায়নি, তারা কেমন শিক্ষা, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য বা পরিবেশ ব্যবস্থাপনা চান?
ভোটের আগে তারা মতামত দিতে পারেনি। ভোটারদের মন জয়ের চিন্তা ক্ষমতাসীনদের মাথায় ছিল না বলে তারা তরুণদের দাবি দাওয়া শুনে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়নি।
তরুণরা প্রার্থীদের মধ্যে তুলনা করার সুযোগ পায়নি। দলগুলোর মধ্যে তুলনা করতে পারেনি। নির্ধারণ করতে পারেনি কোন দল বা কোন প্রার্থী তাদের জন্য সহায়ক হবে।
তরুণদের মধ্যে রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাও বিকশিত হতে পারেনি। এসময় পৃথিবীর বহুদেশে তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেছে। থাইল্যান্ডের উদাহরণ আমাদের সামনেই আছে, সেখানে নতুন রাজনৈতিক দল নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হয়ে প্রায় ক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল। ভারতে নতুন একটি দল আঞ্চলিক নির্বাচনে সফল হয়ে সরকার গঠন করেছে। ইউরোপে বহু দেশে তরুণরা গ্রীন পার্টিগুলো গঠনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু আমরা আমাদের দেশে তরুণদের ন্যূনতম রাজনৈতিক অধিকার পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি।
তরুণরা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি মানে শাসন-প্রক্রিয়া থেকে দেশের নতুন নাগরিকদের বঞ্চিত করা হয়েছে। জনগণের একটি অংশের বয়স ৩৫ পার হলেও সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় তাদের কোনো বক্তব্য এখন পর্যন্ত আমলে নেওয়া হয়নি। এই বঞ্চনা আপাত দৃষ্টিতে তরুণদের হলেও এর ফলে সবচেয়ে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। কারণ, আজকের আলোকিত, সচেতন, কানেক্টেড, বৈশ্বিক যোগাযোগে অভ্যস্ত তরুণদের নতুন চিন্তার সঙ্গে, তাদের কল্পনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলার সবচেয়ে ভাল উপায় হলো গণতান্ত্রিক শাসনপ্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ তৈরি করা। অগণতান্ত্রিক উপায়ে এটি সম্ভব নয়। দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশে সেটি সম্ভব হচ্ছে না, সামনে সম্ভব হবে এমন নিশ্চয়তাও নেই।
এ একথা ভাবা যায় যে, দেশের কয়েক কোটি গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক কখনোই সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়নি এবং নিতে পারবে এমন নিশ্চয়তাও নেই। গত দুই নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের নির্বাচনও যদি এক তরফা হয় তবে এই তরুণদের অনেকের বয়স তার পরের নির্বাচন আসার আগে ৪০ পেরিয়ে যাবে। ততোদিনে আরেকটি নতুন প্রজন্ম ভোটার তালিকায় নাম লেখাবে। তখন গণতন্ত্র আসবে কি না জানি না। তরুণরা সেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারবে কি না জানি না। কিন্তু এরমধ্যেই একাধিক প্রজন্মের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও চিন্তা থেকে দেশ চিরতরে বঞ্চিত হয়ে যাবে।
হয়তো এ কারণেই আমরা সমাজে নতুন আইডিয়ার তীব্র অভাব দেখতে পাচ্ছি। সৃজনশীলতা, আবিষ্কার, উদ্ভাবনী দক্ষতার বিকাশের বদলে দেখতে পাচ্ছি অবক্ষয়। একটা বড় অংশের তরুণদের গ্রাস করেছে হতাশা। অনেকেই নেশা ও ড্রাগের আশ্রয় নিচ্ছে। দুর্নীতি, অনিয়ম, নীতিহীনতা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে তরুণদের বেশি করে আকৃষ্ট করছে। তাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগগুলো প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন পাচ্ছে না। আজকের গ্লোবালাইজড পৃথিবীতে নতুন ধরনের কর্মসংস্থানের জন্য যা প্রয়োজন তা আমরা সরবরাহ করতে পারছি না। ফলে, প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে আমাদের তরুণরা পিছিয়ে পড়ছে। তারা ধীরে ধীরে স্বপ্নহীন হয়ে পড়ছে।
বিতর্কিত নির্বাচনের যে ধারাবাহিকতা তৈরি হয়েছে তাতে রাজনীতিতে নতুন ও ভাল নেতৃত্ব গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র চর্চার কথা কমবেশি আলোচিত হলেও এখন এ ধরনের আলোচনা আর শোনা যায় না। কেননা, কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা শাসক দলের ভেতর এক-কেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা তৈরি করেছে। কারা জনপ্রিয় তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারা এই বিশেষ শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করতে পারছে। কারা এই দুষিত ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা পালন করতে পারছে। ফলে, জনসমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত নতুন নেতৃত্ব উঠে আসা তো দূরের প্রশ্ন, শাসক দলের মধ্যেই যারা দীর্ঘদিনের আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে, জনগণের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করে নেতা হিসেবে তৈরি হয়েছিলেন তাদের গুরুত্বও কমে গেছে। টাকাওয়ালারা নিবেদিত রাজনীতিকদের বিতাড়িত করে মনোনয়ন কিনে নিচ্ছেন। যেনতেনভাবে নির্বাচিত হয়ে তারা দুর্নীতি ও অনিয়মে মনোনিবেশ করছেন। এগুলো তরুণদের সামনে খারাপ উদাহরণ তৈরি করছে। জনসম্পৃক্ত রাজনীতির প্রতি উৎসাহ হারিয়ে তারাও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করে ফেলছে। আর এভাবেই তৈরি হচ্ছে বিস্ময়কর সব কোটিপতি। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের জেলা পর্যায়ের নেতারাও হাজার কোটি টাকা পাচার করতে পারছেন। একজন স্বপ্নবাজ তরুণের সামনে একটা খুব ভাল উদাহরণ নয়। কিন্তু এমন উদাহরণই তার সামনে ঘোরাফেরা করছে। এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে সামনে বড় বিপর্যয় ওঁৎ পেতে থাকবে সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।
আশার কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। শেষেও আশার কথাই বলবো। ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করে শাসকরা তরুণদের ভয়াবহভাবে বঞ্চিত করেছেন। এ কারণে তরুণদের অনেকেই হয়তো নিজেদের বিচ্ছিন্ন ভাবে। তারা মনে করে, এই রাষ্ট্র, রাজনীতি, সরকার, শাসন ব্যবস্থা যেভাবে চলছে সেভাবেই চলবে। এখানে তার বলার কিছু নেই। করার কিছু নেই। তাদের কথা শোনার কেউ নেই। তাদের কথা বলার কেউ নেই।
যখন তরুণরা একসঙ্গে কোনো সামাজিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করে তখন তারা অত্যন্ত সচেতনভাবেই এসব ইস্যুতে সরব থাকে। একজন আরেকজনের কাছে তাদের যুক্তি তুলে ধরে।
কিন্তু অনেকেই তা মনে করে না। আজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দিকে তাকালে তরুণদের মনোভাবের কিছুটা প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয়দের মধ্যে বেশিরভাগই তরুণ। তাদের মধ্যে যে রাজনীতি-সচেতনতা দেখি, রাজনীতি নতুনভাবে গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা দেখি তাতে আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। জার্মানির আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম উন্নয়ন সংস্থা ডয়চে ভেলে কিছুদিন আগে দেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে সামাজিক বিষয়াদিতে তাদের ভূমিকা জোরদার করার বিষয়ে কয়েকটি ওয়ার্কশপ আয়োজন করেছিল। এর সাথে সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ আমার পরিচিত। তাদের কাছে জেনেছি দেশের তরুণরা কি বিপুল আগ্রহে এখানে অংশ নিয়েছিল। আমার বিশ্বাস উপযুক্ত পরিবেশ পেলে এদেশের তরুণরা দেশ গঠনে আরো অনেক সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারবে।
যে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করছে তাদের উচিত এই তরুণদের কথা শোনা। তারা কী বলতে চায়, কী করতে চায় সেটি বোঝা। তাদের বঞ্চনার বিষয়গুলো অ্যাড্রেস করা। আর সেটি হলে, এই তরুণদের বেশিরভাগ ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেমে আসবে। তারা যখন রাজনীতি নিয়ে কথা বলবে, তখন তাতে আমরা ন্যায় বিচার, সামাজিক নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মতপ্রকাশের অধিকারের কথা আমরা বেশি করে শুনবো। কারণ, তারা বাস্তবে একটি অগণতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী শাসনের মধ্যে থাকলেও ভাল পৃথিবীর ছবিও তারা দেখেছে। তারা জানে, কীভাবে নিজের দেশ, নিজের শহর ও গ্রামকে ভাল করে তোলা যায়। সড়কের বেপরোয়া বাসের সঙ্গে যে গণতন্ত্রহীনতার সম্পর্ক আছে, চাকরিতে অন্যায় কোটার সঙ্গে যে কর্তৃত্ববাদী শাসনের সম্পর্ক আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতন ফি বৃদ্ধির সঙ্গে যে দুর্নীতির সম্পর্ক আছে এটা তারা জানে। এসব তথ্য আলাদা করে তাদের জানাতে হয়নি।
তবে দেশের সবখানে তরুণরা সংগঠিত নয়। তাদের কণ্ঠস্বর সবসময় শোনাও যায় না। কিন্তু আশার আভাস আছে।
শত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও তরুণরা কথা বলার চেষ্টা করছে। আজ আমাদের দায়িত্ব হলো, দেশে একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। নতুন ভোটাররা ভোট দিতে পারবে এটা তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ন্যূনতম রাজনৈতিক অধিকার। এখান থেকে শুরু হোক। দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসুক। একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তরুণরা যখন প্রাণখুলে কথা বলতে পারবে তখন তারা নিজেরাই বলতে পারবে তারা কেমন বাংলাদেশ চায়। তারা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছবির মতো দেশগুলো দেখে নিজেদের মনের মধ্যে তেমন একটি দেশের কথাই তো ভাবে। নিজের ঘর কে এলোমেলো করে রাখতে চায়?
নতুন প্রজন্মগুলো যদি রাজনৈতিক হয়ে ওঠে, নিজেদের ভেতর থেকে নতুন নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দলগুলোর মধ্যে যথার্থ স্থান করে নিতে পারে, নিজেদের রাজনৈতিক দল গড়ে তুলতে পারে তাহলে এখনকার রাজনীতি পরিবর্তিত হবে। ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকে বিদ্যমান দলগুলো যেতে বাধ্য হবে।
কিন্তু সবার আগে দরকার ভোটাধিকার। ভোটাধিকার বঞ্চিত কয়েক কোটি তরুণ-তরুণী যদি নিজেদের অধিকার একটু করে জানান দিতে থাকে তবে সেটি বৃহৎ সমুদ্র কল্লোলের মতো বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
আমার মনে হয়, তরুণরা নানাভাবে জানান দিচ্ছে। আর এর মাধ্যমে বাংলাদেশ একটা বড় রূপান্তরের সামনে দাঁড়াবে। আজ হোক বা কাল।