ইরানের পক্ষে এই দুই দেশের সমর্থনের বড় প্রমাণ হলো, ইসরায়েলের ওপর হামলায় মিসাইল গাইডেন্স সিস্টেম হিসেবে ইরান যেমন চীনের বেইদু স্যাটেলাইট নেভিগেশন সিস্টেম ব্যবহার করেছে, এর পাশাপাশি ব্যবহার করেছে রাশিয়ার গ্লনাস সিস্টেম। এছাড়া আগে জানা গিয়েছিল রাশিয়ার সাথে ইউএভি (মনুষ্যবিহীন বিমান) তৈরির গবেষণা চালাচ্ছে ইরান। এ ধরণের কিছু ইউএভি ব্যবহার হয়েছে ইসরায়েলে হামলার সময়ে।
গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে যুদ্ধবিমান থেকে হামলা চালায় ইসরায়েল। এতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় কনস্যুলেট ভবনটি। হামলায় নিহত হন দেশটির শীর্ষস্থানীয় দুই সামরিক কর্মকর্তাসহ ৭ জন। জবাবে গত শনিবার ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে একযোগে ৩০০টিরও বেশি ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। ইরানের হামলার জবাবে এবার দেশটিতে পাল্টা হামলার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে ইসরায়েল।
বলে রাখা ভালো, ১ এপ্রিল ইসরায়েলের হামলার পর থেকেই পাল্টা আক্রমনের হুঁশিয়ারি দেয় ইরান। ১৩ এপ্রিল ইসরায়েলের ওপর ইরানের হামলার দিন দুয়েক আগেই আবার রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রিবাকভ এক বিবৃতিতে জানান, মধ্যপ্রাচ্যে চলমান পরিস্থিতিতে ইরানের সাথে যোগাযোগ রাখছে রাশিয়া। ইসরায়েলের সাথে পশ্চিমা দেশগুলোর আঁতাতের ফলেই অশান্তি তৈরি হয়েছে, এমন ইঙ্গিত দেন তিনি।
রাশিয়ার এই কর্মকর্তার বক্তব্যে বোঝা যায়, ইরানের পাশে আছে রাশিয়া। শুধু তাই নয়, অর্থনৈতিক জোট ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চীন, সাউথ আফ্রিকা) এর সদস্য হিসেবে গত বছর ইরান যুক্ত হয়েছে। এই জোটের সদস্য হিসেবেও ইরানকে সমর্থন দিচ্ছে রাশিয়া। শুধু তাই নয়, আরও কিছুদিন পেছনে গেলে দেখা যায়, সামরিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে একে অপরের ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়ে উঠছে রাশিয়া ও ইরান।
গত বছর মার্চে মাসে রাশিয়ার এক অস্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে সে দেশে যান ইরানের ১৭ সদস্যের এক প্রতিনিধি দল। ফাঁস হওয়া এক গোপন নথি থেকে জানা গেছে, ওই সফরে ইরানের সামনে তুলে ধরা হয় এমন সব অস্ত্রের প্রযুক্তি যা রাশিয়ার থেকে নিতে ইরানকে উদ্বুদ্ধ করা হয়।
সফরের পর রাশিয়ার থেকে সেসব অস্ত্র আসলেই ইরান কিনেছিল কিনা তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
২০২২ সালে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাশিয়াকে ড্রোন এবং ক্ষেপনাস্ত্র সরবরাহ করতে সম্মতি জানায় ইরান। এর বিনিময়ে রাশিয়া থেকে তারা নেয় উন্নত মানের যুদ্ধবিমান এবং আকাশপথে নিরাপত্তার প্রযুক্তি, যার সাহায্যে ইসরায়েল এবং পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে পারবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাশিয়ার সাথে ইরানের মৈত্রী আরও গুরুত্বপূর্ণ চোখে দেখার সময় এসেছে। ওয়াশিংটনের গবেষণা প্রতিষ্ঠান হাডসন ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ্য ফেলো কান কাসাপগলু বলেন, রাশিয়ার বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপনাস্ত্র এবং অন্যান্য প্রযুক্তি যদি ইরান কাজে লাগায়, তবে ইসরায়েল হামলা করলে তার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে পারবে ইরান।
ইসরায়েলে ইরানের হামলার পর ইরানকে সরাসরি সমর্থন না জানালেও, চীন জানিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে তারা। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমশ অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে তারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। উভয় পক্ষকেই ধৈর্য ধরার আহ্বান জানায় চীন। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক শান্তি নিশ্চিত করতে বিশ্বকে আহ্বান জানায় তারা। ইরান ও ইসরায়েলের এই সংঘর্ষকে তারা গাজায় চলমান পরিস্থিতিরই অংশ বলে মনে করেন।
সোমবার ইরান ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মাঝে এক ফোনালাপে ১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে ইসরায়েলের হামলাকে নিন্দা জানায় চীন। কিন্তু ইসরায়েলের ওপর ইরানের পাল্টা হামলাকে তারা নিন্দা জানায়নি। বরং একে ইরানের আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেছে চীন।
এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে চীনের বিশেষ দূত ঝাই জুন সোমবার চীনে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত ইরিত বেন-আবা ভিটালের সাথে দেখা করেন। চীনের এই দ্রুত যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান এবং ওই অঞ্চলে সংঘর্ষ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইরানের সাথে মৈত্রীর ব্যাপারে পশ্চিমা দেশগুলোও জানে। ইরানের কনস্যুলেটে হামলার পর পরই তড়িঘড়ি করে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এর সাথে কথা বলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন। চীন যেন ইরানকে পাল্টা হামলায় নিরুৎসাহিত করে, এমনটাই অনুরোধ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কারণ ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে বড় ধরণের সংঘর্ষ, এমনকি যুদ্ধ শুরু হলে তার ফলাফল যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের কারও জন্যই ভালো ফল বয়ে আনবে না।
রাশিয়া ও চীন মিত্র হিসেবে পাশে থাকায় ঠান্ডা মাথায় এবং সূক্ষ্মভাবে ইসরায়েলে হামলা করতে পেরেছে ইরান। এবং হামলা শেষে দেখা গেছে, এতে ইরানের যত না আর্থিক খরচ হয়েছে, ইসরায়েলের খরচ হয়েছে তার ৩৭ গুণ। শুধু তাই নয়, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল এবং তাদের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এক ধাক্কায় নড়বড়ে করে দিয়েছে ইরানের এই হামলা। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই প্রমাদ গুনছে, জানিয়ে দিয়েছে ইরানে আবারও আক্রমণে তারা ইসরায়েলের পাশে থাকবে না। এছাড়া ইরানের সেনাপ্রধান মোহাম্মদ বাঘেরি জানিয়েছেন, ইসরায়েলের সাথে হাত মিলিয়ে আবার ইরানে হামলা করলে যুক্তরাষ্ট্রকে ছেড়ে কথা বলবে না ইরান। মধ্যপ্রাচ্যে যত মার্কিন ঘাঁটি আছে সবগুলোকে শত্রুঘাঁটি হিসেবে হামলা করবে তেহরান।
পেন্টাগনের সাবেক বিশ্লেষক মিশেল মালুফ এক্ষেত্রে পরিষ্কার একটা ধারণা তুলে ধরেছেন। ইরানের আশেপাশে ৩৫টির মত মার্কিন ঘাঁটি আছে, এবং এই মুহূর্তে সবগুলোই হুমকির মুখে। এক সময় এগুলো ইরানের জন্য প্রচ্ছন্ন হুমকি হিসেবে কাজ করত, কিন্তু এখন তারা নিজেরাই নিরাপদ নয়।
এছাড়া স্পুটনিক সংবাদ মাধ্যমের সাথে কথা বলতে গিয়ে ইরানের কনস্যুলেটে ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানান তিনি। মালুফ বলেন, এক সময়ে বিভিন্ন দেশের কনস্যুলেটগুলোকে নিরাপদ মনে করা হতো। এগুলোকে হামলা করার কথা কেউ ভাবত না। ইসরায়েলের এই হামলার ফলে এখন সে ধারণা ভেস্তে গেলো। এখন আর কনস্যুলেটে হামলার আগে কেউ দ্বিতীয়বার চিন্তা করবে না।
জাতিসংঘ বা যুক্তরাষ্ট্র, কেউই ইরানের কনস্যুলেটে এই হামলার নিন্দা জানায়নি। অথচ এখন ইসরায়েলের ওপর ইরানের হামলার নিন্দা জানাচ্ছে। এটা একেবারেই হতাশাজনক। এতে যুক্তরাষ্ট্রের একচোখামি প্রকাশ পায়।
তিনি আরও বলেন, ইরানের কনস্যুলেটে হামলার পরেও মার্কিনিরা চুপ ছিল বলে ইসরায়েল সাহস পেয়ে গিয়েছিল। আর এখন ইরান তাদের সাহসে পানি ঢেলে দিয়েছে। ইসরায়েলে হামলার মাধ্যমে ইরান বুঝিয়ে দিয়েছে, তোমরা সীমা লঙ্ঘন করেছো, এর মূল্য তোমাদের পেতেই হবে।
ইসরায়েলের সাথে ইরানের যুদ্ধ বেঁধে গেলে আদৌ যুক্তরাষ্ট্র হাত গুটিয়ে থাকবে না মনে করেন মালুফ। আর যুক্তরাষ্ট্র এখানে হস্তক্ষেপ করলে ইরান নিঃসন্দেহে রাশিয়া আর চীনকে এখানে জড়িয়ে ফেলবে। ফলে বড় একটা যুদ্ধের সম্ভাবনা রয়েছে। সুত্র: দ্যা ক্রেডল, ওয়াশিংটন পোস্ট, সিএনএন এবং স্পুটনিক