বঙ্গনিউজবিডি রিপোর্টঃ সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে মানবতার কল্যাণে আজীবন নিয়োজিত থাকা এবং রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালার নির্দেশিত সত্য ও ন্যায়ের পথকে নিজের জীবনের পরম লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করাই হলো নবী জীবনের শিক্ষা। রাজা-বাদশাহ-আমির-ফকির কেউ ছোট কেউ বড় নন। কেউ কারো চেয়ে শ্রেষ্ঠ নন। সব মানুষ সমান। বর্তমান মুসলিম সমাজসহ বিভিন্ন সমাজে এর প্রতিফলন দেখা যায় না। বিশ্ব সমাজে চলমান অসন্তোষ অশান্তির মূল কারণ এটাই।
বিশ্ব শান্তি বা বৈশিক শান্তি বলতে সমগ্র বিশ্বের সকল জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের মধ্যকার শান্তি ও ভ্রাতৃত্ববোধকে বোঝায়। এটি নির্দিষ্ট কোন অঞ্চল কিংবা সমগ্র বিশ্বের জন্য বিবেচিত হবে।
বিশ্ব শান্তির ধারণাটি প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর জনপ্রিয় হয়ে উঠে, ফলে জন্ম নেয় ‘সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের’। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও জাতির মধ্যে শান্তি, একতা,সমঝোতা, ও মিত্রতা ধরে রাখার জন্য সংস্থাটির জন্ম হয়েছিল। কিন্তু সংস্থাটি বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়। শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ অবসানের পর সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের উত্তরসূরি হিসেবে ‘জাতিসংঘ’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কিন্তু এই সংস্থাটিও সার্বিক বিবেচনায় বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ রয়েছে। বিশ্ব ব্যাপী সব রাষ্ট্র একত্রে পরবর্তী বিশ্ব যুদ্ধে লিপ্ত না হলেও আঞ্চলিক বিবেচনায় যুদ্ধ বিগ্রহ কিন্তু থেমে নেই। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় : চলমান আরব-ইসরাইল সংঘাত, সিরিয়ায় বহু মাত্রিক যুদ্ধ বিগ্রহ, সৌদি আরব-ইয়েমেন যুদ্ধ, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, ভারত-চীন সংঘাত, যুক্তরাজ্য-আর্জেন্টিনা যুদ্ধ, সাইপ্রাস সংঘাত, বসনিয়া-হারজেগোভিনায় গণহত্যা, কশোভোয় গণহত্যা, আজারবাইজান-আর্মেনিয়া যুদ্ধ, ইরাক-ইরান যুদ্ধ ছাড়াও মিয়ানমার, লিবিয়া, লেবানন,ও ইরাক প্রভৃতি দেশের আভ্যন্তরিণ সংঘাত উল্লেখযোগ্য। ইতিপূর্বেকার সোভিয়েত ইউনিয়ন-আফগানিস্তান যুদ্ধ কিংবা যুক্তরাষ্ট্র-আফগানিস্তান যুদ্ধ ইত্যাদি কোন যুদ্ধই জাতিসংঘ ঠেকাতে পারে নাই।
তবে যুদ্ধ বিগ্রহ বন্ধই শান্তির একমাত্র মাপকাঠি নয়। শান্তির ব্যাপক ভিত্তিক কর্মপরিধি রয়েছে। ব্যক্তিগত শান্তি, পারিবারিক শান্তি, সামাজিক শান্তি, রাষ্ট্রিয় শান্তি ছাড়াও নিরাপদ ও পর্যাপ্ত খাদ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, চিকিৎসা-বস্ত্র-বাসস্থানের নিশ্চয়তা, মুক্ত চলাচল ও স্বাধীন মত প্রকাশের নিশ্চয়তা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা, নিজ নিজ ধর্ম-কর্ম পালনের নিশ্চয়তা, প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারার নিশ্চয়তা সার্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য। আবার অন্য কোন জনগোষ্ঠীকে আঘাত করে বক্তব্য প্রদান, প্রবন্ধ রচনা কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারও শান্তি প্রতিষ্ঠার অন্তরায়। নির্ভেজাল ও প্রকৃত সত্য জানার ও বলার অধিকারও শান্তি প্রতিষ্ঠার পূর্ব শর্ত। যার ডাহামিথ্যে তথ্যের ভিত্তিতে আমেরিকা ইরাক আক্রমণ করেছিল, রক্ত ঝরেছিল লক্ষ লক্ষ আদম সন্তানের সেই মার্কিন প্রাক্তন পররাষ্ট্র মন্ত্রী কলিন পাওয়েল গত ১৮ অক্টোবর,২০২১ তারিখ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান্। অতএব, প্রকৃত সত্য প্রবাহে বিঘ্ন ঘটানো কিংবা মিথ্যা তথ্য প্রদান বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় একটি অন্যতম প্রধান অন্তরায় হিসেবে বিবেচিত হতে বাধ্য।
২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্ব শান্তি দিবস। দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, বিশ্ব থেকে যুদ্ধ ও সংঘাতের চির অবসান। ১৯৮১ সালে দিনটি সর্ব প্রথম উদযাপিত হয়। সে হিসেবে গত ৩৮ বছর যাবত বিবিধ আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে দিনটি আমরা পালন করে আসছি। এখন প্রশ্ন হলো, এতে কি বিশ্বের দেশে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ? উত্তর হলো ‘না’।
এবার দেখা যাক প্রায় ১৪৫০ বছর পূর্বে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার মহানায়ক আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ঘোষিত রহমাতুল্লিল আলামীন মহামানব হুজুর পাক (সাঃ) সার্বিক শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কি ভূমিকা রেখেছিলেন। ৬২২ খ্রীস্টাব্দে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মক্কা থেকে মদিনায় আগমনের পর থেকে তাঁর মাদানী জীবন শুরু হয়। মক্কা থাকা কালীন সময়ে তিনি ছিলেন শুধু ধর্ম প্রচারক। কিন্তু মদিনায় এসে তিনি রাষ্ট্রনায়কের মর্যাদা লাভ করেন। সেখানে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন একটি কল্যানময় ইসলামি রাষ্ট্র। সেখানে তিনি সামাজিক ন্যয় নীতি, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সামাজিক সংস্কার, অর্থনৈতিক নীতিমালা নির্ধারণ, শিক্ষা-সংস্কৃতির নীতিমালা প্রবর্তন ও নতুন সভ্যতার গোড়াপত্তন করেন। একই সাথে তিনি ধর্মীয় অনুশাসন প্রতিষ্ঠায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
ইসলাম প্রতিষ্ঠাকালে হুজুর পাক (সাঃ)-কে অনেক বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করতে হয়েছে। ইসলাম বিরোধী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে অনেকগুলো যুদ্ধ করতে হয়েছে। অবশেষে তিনি ইসলামের চিরন্তন শান্তির অমিয় বানী আরব অঞ্চলের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জাতির কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন। বিশ্বকে তিনি উপহার দিলেন চিরন্তন কালজয়ী এক জীবন ব্যবস্থা ও একটি আদর্শ সমাজ কাঠামো। যা মানব ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় ও অদ্বিতীয় ঘটনা।
তৎকালীন মদিনায় পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত থাকা ৫ (পাঁচ) শ্রেণির যেমন–মহাজেরিন, আনসার, ইহুদি, খ্রিস্টান, ও মুশরিক অধিবাসী বসবাস করতো। তাদের মধ্যে শান্তি সম্পৃতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর একটি সনদ বা সংবিধান প্রনয়ণ ও বাস্তবায়ন করেন। যা আজ-অব্দি মদিনা সনদ নামে বিখ্যাত হয়ে আছে। মদিনা সনদ মহানবী (সাঃ)-এর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, কুটনৈতিক দূরদর্শিতা, ও অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় বহন করে।
এই মদিনা সনদের ধারাবাহিকতার পথ ধরে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় পরবর্তী যুগে যথাক্রমে ১২১৫ সালে ‘ম্যাগনাকার্টা’, ১৬২৮ সালে ‘পিটিশন অব রাইটস’, ১৬৭৯ সালে ‘হেবিয়াস কার্পাস অ্যাক্ট’, ১৬৮৯ সালে ‘বিল অব রাইটস’, এবং ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত ‘সার্বজনীন মানবাধিকার’ নীতিমালা ঘোষিত হয়। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার এই দলিলকে জনাব মন্টোগোমারি ওয়াট তার গ্রন্থ ‘Muhammad at Madina’-য় বলেছেন ‘The Constitution of Madina’ অর্থাৎ মদিনার সংবিধান। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর আরো একটি কীর্তি হচ্ছে ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’। আপাতদৃষ্টিতে যা নতজানু সন্ধি হিসেবে বিবেচিত হলেও মহান আল্লাহ পাক সেটিকে ‘সুস্পষ্ট বিজয়’ বলে অভিহিত করেছেন।
এবার মদিনা সনদে কি রয়েছে তা পর্যালোচনা করা যেতে পারে। মদিনা সনদে ৪৭টি ধারা ছিল, আর ধারা-উপধারা মিলে সীদ্ধান্ত ছিল ৬১টি। মদিনা সনদের উল্লেখযোগ্য ধারাগুলো হলো:
১. মদিনা সনদে স্বাক্ষরকারী মুসলমান, ইহুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক-সহ সব সম্প্রদায় একটি সাধারণ জাতি গঠন করবে এবং সব সম্প্রদায় সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে।
২. হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নবগঠিত মদিনা প্রজাতন্ত্রের সভাপতি হবেন এবং পদাধিকার বলে তিনি মদিনার সর্বোচ্চ বিচারালয়ের সর্বময় কর্তা হবেন।
৩.সব নাগরিক পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করবে। কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করবে না।
৪. কেউ কুরাইশদের সাথে বা অন্য কোন বহিঃশত্রুর সাথে কোনো প্রকার গোপন সন্ধি করতে পারবে না। কিংবা মদিনা বাসীর বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রে কুরাইশদের সাহায্য করতে পারবে না। কোনো সম্প্রদায় মদিনা প্রজাতন্ত্রের স্বার্থের পরিপন্থী কোনো কাজে লিপ্ত হতে পারবে না।
৫. সনদে স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়ের কোনো ব্যক্তি অপরাধ করলে তা ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এজন্য অপরাধির সম্প্রদায়কে দায়ী করা যাবে না।
৬. মদিনা নগরী আক্রান্ত হলে দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সবাই যুদ্ধ করবে এবং প্রতিটি সম্প্রদায় নিজ নিজ ব্যয়ভার বহন করবে।
৭. মদিনা নগরীকে পবিত্র বলে ঘোষণা করা হলো এবং এখানে রক্তপাত, হত্যা, বলাৎকার, ও অপরাধমূলক কাজ নিষিদ্ধ করা হলো।
৮. দূর্বল ও অসহায়কে সর্বাত্মকভাবে সাহায্য ও রক্ষা করতে হবে।
৯. অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তি ভোগ করতে হবে এবং সব ধরনের পাপী ও অপরাধীকে ঘৃনার চোখে দেখতে হবে।
(পাপ এবং অপরাধ সমার্থক নয়। পাপকে ঘৃনা করো পাপীকে নয়—– বর্তমান সময়ের এসব শ্লোগান মদিনা সনদ পরিপন্থী)
১০. হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পূর্বানুমতি ব্যতিত মদিনাবাসী কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে না।
১১. নিজেদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর বিধান অনুযায়ী তা মিমাংসা করে দিবেন।
১২. এই সনদের শর্ত ভঙ্গকারীর উপর আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষিত হবে।
১৩. ইহুদিদের মিত্ররাও সমান নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা ভোগ করবে।
মদিনা সনদে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এই সনদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো—-এতে পার্থিব ও ধর্মীয় বিধানের সমন্বয় হয়েছে। মহানবী (সাঃ) মদিনা সনদের মাধ্যমে প্রকারান্তরে আল্লাহর বিধানকে কার্যকর করেছেন। তাই মদিনা সনদ সবার কাছে অদ্যাবধি গ্রহণযোগ্য রয়েছে।
পৃথিবীর পূর্বাপর সব সংবিধানের মধ্যে মদিনা সনদই শ্রেষ্ঠ বলে প্রমাণিত হয়েছে। এ সংবিধানের আলোকে যে কোন দেশের নিয়মশৃঙ্খলা পরিচালিত হলে আজও তা সব নাগরিকের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।
পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ) আজ বুধবার ১২ রবিউল আউয়াল, ১৪৪৩ হিজরি; ২০ অক্টোবর, ২০২১খ্রিষ্টাব্দ; এবং ৪ কার্তিক,১৪২৮ বাংলা। হিজরি সালে ১২ রবিউল আউয়াল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) জন্মগ্রহণ করেন এবং একই দিনে তিনি পৃথিবী থেকে বিদায়ও নেন। তাই দিনটি নিয়ে মুসলিম উম্মাহর মধ্য রয়েছে বিশেষ আবেগ। প্রতি বছর মুসলমানরা দিনটি পালনের মাধ্যমে আখেরি নবী (সাঃ)-এর আদর্শকে স্মরণ করে এবং নিজ নিজ ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিফলন ঘটানোর অনুশীলন করে আসছে।
ড. হাবিবুর রহমান খান
বিশিষ্ট শিক্ষা ও জনসংযোগবিদ