ডেস্ক : সবার জন্য যেদিন পদ্মা সেতু খুলে দেয়া হয়, সেদিন রোববার ভোর থেকেই পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তের টোল প্লাজার সামনে যানজট লেগে গিয়েছিল।
ঠিক ৪৮ ঘণ্টা পরে মঙ্গলবার সকালে সরেজমিনে সেখানে গিয়ে দেখা গেছে একেবারে উল্টো চিত্র।
সেতুর সামনে কোনো যানজট নেই, গাড়িও আসছে একটু পরপর। মাঝে মাঝে কোনো কোনো টোল প্লাজার কাউন্টার অনেকক্ষণ ধরে ফাঁকা থাকছে।
মাওয়া বা জাজিরা- উভয় প্রান্তে প্রথম দিনের তুলনায় যানবাহনের সংখ্যা এক-চতুর্থাংশে নেমে এসেছে।
এর কারণ হিসেবে কর্মকর্তারা বলছেন, মোটরসাইকেল বন্ধ করে দেয়ার কারণে যানবাহনের চাপ ৭০ শতাংশ কমে গেছে। আবার কড়াকড়ির কারণে এবং সেতুতে দাঁড়াতে না দেয়ার কারণে সেতু দেখতে আসা পর্যটকদের সংখ্যাও কমেছে।
পিকআপে মোটরসাইকেল তুলে সেতু পাড়ি দিয়েছেন চালকরা। তবে মঙ্গলবার তাতেও পুলিশ বাধা দেয়। এরপর তারা পিকআপে মোটরসাইকেল তুলে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেন। নিজেরা বাসে করে অন্যপাশে গিয়ে আবার মোটরসাইকেলে ওঠেন।
যানবাহনের সংখ্যা চারভাগের একভাগে কমে এসেছে
মঙ্গলবার সকাল ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত মাওয়া প্রান্তের টোল প্লাজার সামনে দাঁড়িয়ে গত দুই দিনের তুলনায় সেতুতে যানবাহন চলাচল অনেক কম দেখা গেছে।
রোববার ভোর সাড়ে ৫টায় যানজটের কারণে সেতু থেকে দুই কিলোমিটার দূরে দাঁড়াতে বাধ্য হতে হয়েছিল। সেতু পার হতে লেগেছিল দুই ঘণ্টা।
কিন্তু মঙ্গলবার সকাল ৭টায় পদ্মা সেতুর টোল প্লাজায় গিয়ে সামনে অপেক্ষমাণ একটি গাড়িও দেখা যায় না।
টোল কাউন্টারের একজন কর্মী জামিলা আক্তার বলছেন, ‘প্রথম দিন প্রচণ্ড ভিড় ছিল, বিশেষ করে মোটরসাইকেলগুলো। আমরাও হিমশিমের মধ্যে ছিলাম। কাল সকালের দিকে গাড়ির চাপ কম ছিল, বিকেলে আবার হালকা চাপ ছিল। আজ সকাল থেকে একেবারে চাপ নেই।’
এর কারণ হিসেবে কর্মকর্তারা বলছেন, মোটরসাইকেল বন্ধ করে দেয়ার কারণে যানবাহনের চাপ অনেক কমে গেছে।
সেতু কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী তোফাজ্জল হোসেন বলছেন, প্রথম দিন মোটরসাইকেলই ছিল মোট যানবাহনের মধ্যে ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ। সেটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গাড়ির চাপ কমেছে।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘প্রথম দিনে মোটরসাইকেল থাকার কারণে যানজট এবং অন্যান্য সমস্যাগুলো তৈরি হয়েছিল। আজ একেবারেই স্বাভাবিক অবস্থা, যানজট নেই। যেসব গাড়ি আসছে, দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছে। সেতুর ওপরে লোকজনের থামার প্রবণতা অনেক কম।’
‘তবে দিন দিন গাড়ি বাড়বে বলে আমরা আশা করছি। অনেকের বাসের এদিকে রুট পারমিট নেই, অনেকে নতুন করে বাস নামানোর পরিকল্পনা করছেন। ফলে সামনের দিনগুলোতে এই রুটে যানবাহনের সংখ্যা আরো বাড়বে বলে আমরা ধারণা করছি,’ তিনি বলছেন।
সোমবার ভোর ৬টা থেকে মঙ্গলবার ভোর ৬টা পর্যন্ত সেতু দিয়ে ১৫ হাজার ৪২৯টি যানবাহন পার হয়েছে। এই সময় টোল আদায় হয়েছে ১ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।
রোববার প্রথম ২৪ ঘণ্টায় সেতু দিয়ে মোট ৬১ হাজার যানবাহন পার হয়েছিল। প্রথম দিন টোল আদায় হয়েছিল ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
সেতুর ওপর পুলিশ ও সেনাবাহিনীর টহল
প্রথম দিনের মতো পদ্মা সেতুতে কেউ গাড়ি থেকে নামতে না পারেন বা ছবি-ভিডিও করার চেষ্টা করতে না পারেন, সেজন্য একটু পরপর পুলিশ আর সেনাবাহিনীর সদস্যদের টহল দিতে দেখা গেছে।
প্রখর রোদের মধ্যেও সেতুর ওপর একটু পরপর দাঁড়িয়ে ছিলেন পুলিশের সদস্যরা। নিরাপত্তা বাহিনীর পিকআপগুলো মাঝে মাঝেই ঘুরে যাচ্ছে।
কোনো গাড়ি দাঁড়ালে বা গতি কমালে তারা চলে যাওয়ার জন্য তাগাদা দিচ্ছেন।
ফলে রোববার এই সেতুর ওপর জায়গায় জায়গায় মানুষের জটলা বা ভিড় থাকলেও মঙ্গলবার ছিল একেবারে ফাঁকা।
ত্রিপলে ঢেকে পিকআপে করে পদ্মা সেতু পার হচ্ছে মোটরসাইকেল
রোববার পদ্মা সেতুতে যানজট এবং চরম বিশৃঙ্খলা তৈরির পর সেতুর ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করে কর্তৃপক্ষ।
সেদিন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দু’জনের মৃত্যুও হয়।
সোমবার অনেক চালককে পিকআপ ভ্যানের ওপর মোটরসাইকেল তুলে সেতু পার হতে দেখা গেছে। তবে মঙ্গলবার সকালে তাতেও বাধা দেয় পুলিশ।
মাওয়া টোল প্লাজার সামনেই এরকম একটি পিকআপ আটকে দেয় পুলিশ। সেই পিকআপ ভ্যানে নিজের মোটরসাইকেলের ওপর বসে ছিলেন এনায়েতুল্লাহ অমিত।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘যারা সেতুর ওপর জোরে চালাবে, নামবে বা ছবি তুলবে, তাদের আটক করা হোক, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক। কিন্তু আমরা যারা কাজে সেতু পার হতে চাই, আমাদের কেন সেই সুযোগ দেয়া হবে না?’
১০ মিনিট পর এরকম আরেকটি পিকআপ আটকে দেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
তাদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, ৬০০ থেকে এক হাজার টাকা চুক্তিতে একেকটি মোটরসাইকেল সেতু পার করছে এসব পিকআপ। সেতুর একটু আগে থেকেই পিকআপগুলোয় মোটরসাইকেল তোলা হয়। এরপর সেতুর অন্য পাশে গিয়ে নামিয়ে দেয়া হয়।
তবে মঙ্গলবার কর্তৃপক্ষ বলছে, পিকআপ ভ্যানে করেও মোটরসাইকেল উঠে বা যাত্রী হিসেবে পারাপার করা যাবে না।
তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘পণ্য হিসেবে মোড়ক দিয়ে বেঁধে নিয়ে গেলে সমস্যা নেই। কিন্তু প্যাসেঞ্জার মোটরসাইকেলের ওপর বসে, পিকআপের ওপরে নিয়ে গেলে সমস্যা আছে।
ব্রিজের ওপরে গিয়ে তারা হয়তো আবার নামতে পারে, মোটরসাইকেলসহ। চারজন ধরে নামবে, চালাবে, সেগুলো ফেসবুকে দিয়ে একটা নেগেটিভ খবর তৈরি করবে। এই কারণে আমরা প্যাসেঞ্জারসহ মোটরসাইকেল পিকআপের ওপর চড়ে যেতে দিচ্ছি না।’
এনায়েতউল্লাহর মতো বেশ কয়েকজন মোটরসাইকেল চালককে দেখা গেছে, তারা পিকআপে মোটরসাইকেল তুলে দিয়ে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন। এরপর টোল প্লাজার আগে বাসে করে সেতু পার হয়ে অন্য পাড়ে গিয়ে আবার মোটরসাইকেল নামিয়ে নিচ্ছেন।
বাসে করে সেতু দর্শন
বরিশাল থেকে তৈয়ব আলী আর সাতক্ষীরা থেকে পদ্মা সেতু দেখতে এসেছেন বাকি বিল্লাহ। তারা বাসে করে এসে পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে মাওয়া প্রান্তে নেমেছেন। এরপর আবার আরেকটি বাসে করে ফেরার জন্য মাওয়া প্রান্তে টোল প্লাজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেই সময় তাদের সাথে কথা হয় বিবিসি বাংলার সংবাদদাতার।
তৈয়ব আলী বলছেন, ‘সেতুটা দেখার খুব শখ হইছিল। তাই বাসের টিকেট কেটে উঠে পড়ছি। নামতে দেয়নি, তাতে একটু কষ্ট পেয়েছি। তারপরেও দেখা তো হলো, সেতুর ওপর দিয়ে চলাচল তো হলো।’
বাকি বিল্লাহ বলছেন, তিনি ছোট ভাগ্নেকে সাথে করে নিয়ে এসেছেন।
‘কতবার ফেরিতে করে এই নদী পার হয়েছি। একবার তো লঞ্চে করে ঢাকা আসার সময় প্রায় মরতে বসেছিলাম। অথচ এখন মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পদ্মা পাড়ি দিয়ে এবার চলে এসেছি। বিশ্বাসই হয় না,’ বলেন তিনি।
মাওয়া এসে তারা নদীর পাড়ে ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খেয়েছেন। এখন আবার সাতক্ষীরা ফিরে যাবেন।
মাওয়া আর জাজিরা টোল প্লাজার সামনে তাদের মতো আরন্ অনেককে পাওয়া গেল। তারা বিভিন্ন জেলা থেকে পদ্মা সেতু দেখার জন্যই এসেছেন। সেতুতে নামতে না পারলেও, সেটার ওপর দিয়ে পাড়ি দিতে পেরে তারা আনন্দিত।
ফরিদপুরের ভাঙ্গাতেও দেখা গেছে, অনেক মানুষ এসে বাসে করে পদ্মা সেতুর দেখার জন্য বাসস্ট্যান্ডে জড়ো হয়েছে।
তহুর হোসেন তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থেকে পদ্মা সেতু দেখার জন্য এসেছেন। মঙ্গলবার সকালে যখন তার সাথে কথা হয়, তখন তিনি একটি বাসের টিকেট কিনে ওঠার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
ফেরি চলাচল অব্যাহত থাকবে
পদ্মা সেতু চালু হলেও ফেরি চলাচল অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
মঙ্গলবার তিনি জানিয়েছেন, চাহিদা অনুযায়ী শিমুলিয়া থেকে মাঝিরঘাট রুটে ফেরি চলবে।
‘আমরা তো ফেরি বন্ধ করে দেইনি, সেখানে ছয়টি ফেরি চলাচল করছে। যেভাবে চাহিদা থাকবে, সেভাবে আমরা সেখানে ফেরি ব্যবহার করব,’ বলেন তিনি।
মোটরসাইকেল চলাচল প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা অনির্দিষ্টকালীন সিদ্ধান্ত নয়। এখন এটা বন্ধ আছে। তবে সেতুতে স্পিড গান, সিসিটিভি বসানো হবে। সেগুলো বসানোর পর হয়তো নতুন করে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’ সূত্র : বিবিসি