বঙ্গনিউজবিডি ডেস্ক: করোনার কারণে ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় দেড় বছর ধরে খেলাপি ঋণের ওপর শিথিলতা দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নীতিমালার কারণে এ সময়ে কোনো গ্রাহক ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করলেও খেলাপি করতে পারছে না ব্যাংকাররা। বলা চলে কার্যত দেড় বছর ধরে ঋণ আদায় তেমন একটি হচ্ছে না। পাশাপাশি বৈদেশিক বাণিজ্য বা আমদানি-রফতানির করুণ দশায় কমিশন ব্যবসাতেও ধস নেমেছে। কিন্তু এর পরও চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে (জানুয়ারি-জুন) প্রতিটি ব্যাংকেরই পরিচালন মুনাফা বেড়ে গেছে।
মূলত নীতিমালা শিথিলের জাদুতে ঋণ আদায় না হলেও পুঞ্জীভূত ঋণের ওপর যে সুদ হচ্ছে, তা আয় খাতে নিতে পারছেন ব্যাংকাররা। এ কারণেই মুনাফার ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে ব্যাংকাররা জানান।
জানতে চাইলে সাউথ ইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম কামাল হোসেন গতকাল বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, বৈদেশিক বাণিজ্য থেকে যে কমিশন পাওয়া যেত, সেটি করোনার বৈশ্বিক প্রভাবে কমে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেঁধে দেয়া করোনাকালীন প্রণোদনা প্যাকেজের বাইরে নতুন তেমন ঋণ বিতরণ হচ্ছে না। গত বছরের জানুয়ারি থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকঋণ আদায়ের ওপর শিথিলতা দিয়েছে। বলা হয়েছে, ঋণ আদায় না করলেও খেলাপি করা যাবে না। ফলে মেয়াদি ও চলতি বিনিয়োগ থেকে তেমন ঋণ আদায় হচ্ছে না। পরেও ব্যাংকের মুনাফা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি জানান, যেসব ঋণ নিয়মিত রয়েছে ওই সব ঋণের বিপরীতে অর্জিত সুদ আয় খাতে নেয়া হচ্ছে। এ কারণেই বেড়েছে ব্যাংকের মুনাফা। আমানতকারীদের সুদে-আসলে নগদে অর্থ ফেরত দেয়া হচ্ছে, ব্যাংকগুলো যে পরিচালন মুনাফা দেখাচ্ছে তার বিপরীতে সরকারের করপোরেট ট্যাক্স হিসেবে সাড়ে ৩৭ শতাংশ নগদে পরিশোধ করতে হচ্ছে, শুধু ভবিষ্যতে সুদ আদায় হবে তার ওপর ভিত্তি করে আয় বাড়ানো হচ্ছে। এটি ব্যাংকিং খাতের জন্য কতটা যুক্তিযুক্ত- এমন প্রশ্নের জবাবে সাউথ ইস্ট ব্যাংকের এমডি জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা শিথিলের কারণে গ্রাহক ঋণ পরিশোধ না করলেও ওই ঋণখেলাপি হচ্ছে না। আর ঋণখেলাপি না হলে ব্যাংকের খাতায় ওই ঋণ নিয়মিত হিসাবে দেখাতে দোষের কিছু না। আর এ নিয়মিত ঋণের বিপরীতে বছর শেষে যে সুদ হবে তা আয় খাতে নেয়াও দোষের কিছু না। তিনি মনে করেন, নিয়মিত ঋণের বিপরীতে অর্জিত সুদ আয় খাতে নেয়া না হলে ব্যাংকের সব কিছুই ঋণাত্মক হয়ে যাবে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুযোগ না দিলে অনেক ঋণখেলাপি হয়ে যেত। আর ওই খেলাপি ঋণের বিপরীতে বাড়তি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হলে মুনাফা কমে যেত। এ ছাড়া নীতিমালা অনুযায়ী মন্দ ঋণের বিপরীতে সুদ আয় স্থগিত রাখতে হয়। সব মিলেই ব্যাংকের জন্য ভালো হতো না।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকের ১০০ টাকা ঋণ থাকলে আর ওই ঋণ নিয়মিত থাকলে সংশ্লিষ্ট ঋণ আদায় না হলেও ওই ১০০ টাকার ওপর ৯ শতাংশ সুদ হিসেবে ব্যাংক আয় খাতে নিতে পারে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালায় কোনো বাধা নেই। অর্থাৎ ঋণ ও সুদ আদায় না করেও সুদ আয় খাতে নিতে পারছে ব্যাংকগুলো। দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ আদায়ের ওপর শিথিলতা ব্যাংকিং খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ এক দিকে ঋণ আদায় হচ্ছে না, অন্য দিকে আমানতকারীদের আমানত ফেরত দিতে হচ্ছে। আবার ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। সব মিলেই ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। সম্পদের গুণগত মান খারাপ হয়ে যাচ্ছে। যার প্রভাব ভবিষ্যতে দেখা দেয়ার আশঙ্কা করছেন ব্যাংকাররা।
জানা গেছে, বছরের শেষ দিনে ব্যাংকগুলো তাদের সারা বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব করে থাকে। বের করে তাদের পরিচালন মুনাফা। তবে এ মুনাফা একেবারেই প্রাথমিক হিসাব। প্রকৃত মুনাফা আরো কমে যাবে। যথাযথভাবে খেলাপি ঋণের হিসাব করা হলে এবং বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করা হলে, পাশাপাশি সরকারকে সাড়ে ৩৭ শতাংশ কর পরিশোধের পর এটি চার ভাগের এক ভাগও থাকবে না।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফার একটি বড় অংশই চলে যাচ্ছে দুর্নীতির দায়ে সৃষ্ট খেলাপি ঋণের দায় মেটাতে। জালিয়াতির মাধ্যমে যেসব ঋণ দেয়া হচ্ছে, সেগুলো আদায় হচ্ছে না। ফলে এগুলো খেলাপিতে পরিণত হয়ে ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতেই ক্ষয়ে যাচ্ছে মুনাফা। এর বাইরেও ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণকে নিয়মিত দেখিয়ে, খেলাপি ঋণের বিপরীতে সুদ আয় দেখিয়ে, আমানতের সুদের বিপরীতে সংরক্ষিত প্রভিশন ও ঋণের বিপরীতে সম্ভাব্য সুদকে আয় হিসেবে দেখিয়ে মুনাফা বাড়াচ্ছে। এ ছাড়াও বেআইনিভাবে গ্রাহকদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের চার্জ আদায় করে মুনাফার অঙ্ক বাড়াচ্ছে। অতীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে ধরা পড়ার পর এগুলো ফেরত দেয়ার নজিরও রয়েছে।
সূত্র জানায়, ব্যাংকের হিসাবে বিভিন্ন টার্ম রয়েছে। মেয়াদি আমানতের বিপরীতে বার্ষিক সুদ বা মুনাফার অংশ ‘পেয়েবল’ হিসেবে প্রভিশন করতে হয়। কোনো কোনো ব্যাংক ওই পেয়েবল হিসেবে রাখা টাকাকে আয় খাতে প্রদর্শন করছে। এ ছাড়া ঋণের বিপরীতে সম্ভাব্য আয় নির্ধারণে ‘রিসিভেবল’ হিসেবে টাকা রাখা হয়। ভবিষ্যতে আয় হতে পারে এমন একটি অঙ্ক রিসিভেবল আয় হিসেবে গণ্য হয়। কিন্তু ওই অঙ্কেই আয় প্রকৃতপক্ষে না হলেও তা আয় হিসেবে প্রদর্শন করছে ব্যাংকগুলো। এতেও বাড়ছে মুনাফা।
কোনো ঋণের বিপরীতে সুদ আদায় না হলে তা আয় হিসেবে দেখাতে পারে না ব্যাংকগুলো। এ ছাড়া খেলাপি ঋণের বিপরীতেও কোনো আয় দেখাতে পারে না। এই ক্ষেত্রে সুদ হিসাব করে আলাদা একটি হিসাবে জমা রাখতে হয়। কেবল আদায় হলেই তা আয় খাতে নেয়া যাবে। এর আগে নয়। কিন্তু ব্যাংকগুলো সুদ আদায় না করেই কাগুজে আকারে মুনাফা আয় খাতে নিয়ে যাচ্ছে। সূত্র জানায়, বছরের শুরুতে পরিচালকরা ব্যাংক নির্বাহীদের বিভিন্ন খাতে ব্যবসার একটি লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়। এটি অর্জন করতে না পারলে পদোন্নতি আটকে যায়, প্রফিট বোনাস কম পাওয়া যায়। এসব কারণে ব্যাংকাররা পরিচালকদের চাপে অনেকসময় বাড়িয়ে দেখার নজিরও অতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে বের হয়ে আসে।
ছয় মাসের মুনাফার ঊর্ধ্বগতি : বিভিন্ন ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) বরাবরের মতো পরিচালন মুনাফার শীর্ষে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক। ব্যাংকটি গত ছয় মাসে মুনাফা করেছে এক হাজার ২০ কোটি টাকা, আগের বছরের একই সময়ে ছিল এক হাজার সাত কোটি টাকা। পূবালী ব্যাংকের ছয় মাসে মুনাফা ৫০৩ কোটি টাকা, আগের ছয় মাসে ৪০৫ কোটি টাকা। সাউথইস্ট ব্যাংক মুনাফা করেছে ৪৭২ কোটি টাকা, আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩৪২ কোটি টাকা। মার্কেন্টাইল ব্যাংক ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা করেছে ৩৫৮ কোটি টাকা, আগের বছরের ছয় মাসে ছিল ২৪৩ কোটি টাকা। এক্সিম ব্যাংক পরিচালন মুনাফা করেছে ৩৪০ কোটি টাকা, আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩১৭ কোটি টাকা। আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক পরিচালন মুনাফা করেছে ছয় মাসে ৩১০ কোটি টাকা, আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩০৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া ঢাকা ব্যাংক ৩১০ কোটি টাকা, আগের বছরের ছয় মাসে ২৬৩ কোটি টাকা, যমুনা ব্যাংকের ৩০১ কোটি টাকা, আগের বছরে ২৬২ কোটি টাকা, প্রিমিয়ার ব্যাংক ৩০০ কোটি টাকা, আগের বছরে ১৮৩ কোটি টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ২২৭ কোটি টাকা, আগের বছরে ১৭৫ কোটি টাকা।
নতুন প্রজন্মের এনআরবিসি ব্যাংক মুনাফা করেছে ছয় মাসে ১৫০ কোটি টাকা, আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৯১ কোটি টাকা, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক ছয় মাসে মুনাফা করেছে ৮০ কোটি টাকা, আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৭০ কোটি টাকা। মধুমতি ব্যাংক ১২৭ কোটি টাকা, আগের বছরে ১২৪ কোটি টাকা, মেঘনা ব্যাংক ছয় মাসে মুনাফা করেছে ৭০ কোটি টাকা, আগের বছরের একই সময়ে করে ১২ কোটি টাকা। সূত্র: নয়া দিগন্ত