সূফী লেখক, মুহাম্মদ রাকিব বিন রহিমঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরবর্তী সময়ে তাঁর প্রচারিত ইসলামকে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব পালন করেন সূফী সাধকরা। তারা নিজেদের জীবনকে সংকটাপন্ন করে সুদূরে পাড়ি জমিয়েছেন এবং ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করেছেন যথাযথভাবে। আল্লাহর ইচ্ছাই তাদের ইচ্ছায় পরিণত হয়েছে। তেমনি এক মহান সাধক হলেন হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রঃ)। তিনি তার সাধনা মাধ্যমে ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত করেছেন আল্লাহ ও রাসুলের ধর্মকে। হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রঃ ) এর প্রতিষ্ঠিত তরিকাকে বলা হয় চিশতীয়া তরিকা। খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) কে চিশতীয়া তরিকার ইমাম ও কুতুব বলা হয়। তিনি ১১৮৫ খ্রিঃ/৫৮১ হিঃ সালে ভারতবর্ষে আগমন করে ইসলামের প্রচার করেন। চিশতিয়া তরিকার ইমাম ও কুতুব হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রঃ) ১১৪২ খ্রিঃ /৫৩৬ হিঃ সালে ইরান ও আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী জেলার সানজারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ গিয়াস উদ্দীন সঞ্জরি (রহঃ) এবং মাতার নাম সৈয়্যেদা উম্মেওয়ারা বিবি (রহঃ)।
তিনি পিতৃকুল ও মাতৃকুল উভয়দিক থেকেই ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনের বংশধর। খাজাবাবা খাজা উসমান হারুনীর খেদমতে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। দীর্ঘসময় তিনি তার মুর্শিদের সেবায় নিয়োজিত থাকেন।
খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) তাঁর মুর্শিদ কেবলার সঙ্গে হজব্রত পালন শেষে মদিনায় গমন করেন। মদিনায় স্বীয় মুর্শিদ হযরত খাজা ওসমান হারুনী তাঁকে রাসুলের হাতে তুলে দেন। নবীজী (সঃ)খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রঃ)-কে হিন্দুস্থানে গিয়ে ইসলাম প্রচারের জন্য নির্দেশ দেন।
খাজা উসমান হারুনী (রহঃ) তাঁর প্রিয় শিষ্যকে সঙ্গে নিয়ে মদিনা থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশে মক্কায় ফিরে আসেন। পরে ওহাবি আন্দোলনে তাঁর মাজারসহ সকল মাজার নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে। মুর্শিদের ওফাতের পর খাজাবাবা দারুণ ব্যথিত হৃদয় নিয়ে হিন্দুস্থানের পথে রওনা হন। খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) হুজুর বেরীর (রহঃ) দরজায় দুছত্র ফারসি কবিতা লিখেছিলেন যা আজো শ্রদ্ধার সঙ্গে সকলে পড়ে থাকেন। কবিতাটি হলো ‘গঞ্জে বখশ জগতের প্রেরণা ও খোদার নূরে। (তিনি অসামর্থ্যদের পীরে কামেল আর কামেলদের পথপ্রর্দশক।’) লাহোর ত্যাগ করে তিনি দিল্লি ও পরে রাজপুত শক্তির কেন্দ্রবিন্দু আজমিরে আস্তানা করেন। খাজা বাবার অপার মহিমায়, মানব প্রেম ও চারিত্রিক মাধুর্যে মোহিত হয়ে হিন্দু প্রভাবশালীদের প্রবল বাধা বিপত্তির মধ্যেও দলে দলে লোক ইসলাম গ্রহণ করে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে থাকে। এতে হিন্দু রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) কে আজমির ত্যাগের নির্দেশ দেন। মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ ঐ সময় বলেছিলেন ‘আমি পৃর্থিরাজকে জীবিত বন্দী করে শিহাবুদ্দীন ঘোরীর হাতে তুলে দিলাম।’ তাঁর এই ভবিষদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছিল।
এভাবে ভারতবর্ষে মুসলমান রাজত্ব কায়েম হয়। ভারতবষের্র দিল্লি ও আজমির মুসলিম শাসনে আসার পর মধ্যপ্রাচ্য থেকে সূফী সাধক, দরবেশ ফকিররা ভারতবর্ষে এসে ইসলাম প্রচার করেন। এঁদের মধ্যে প্রায় সবাই মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁর দোয়া ও অনুমতি নিয়ে দূর-দূরান্তের বিশেষ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন এবং বসতি স্থাপন করে ইসলাম প্রচার করে জীবনপাত করেছেন। যাঁর প্রচেষ্টার ফসল হলো ভারতবর্ষে ইসলামের সূর্যের উদয় এবং উদয়ের ফলান্তে এদেশের মানুষ ইসলামের শান্তি লাভ করে। শরিয়ত-মারেফতের আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে সত্যিকারের পথ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ প্রাপ্তি হয়। চিশতীয়া তরিকার উত্থান বহুপূর্বে হলেও ভারতবর্ষে মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) এই তরিকায় দিয়েছেন এক নতুন পরিচিতি। তিনি তরিকতের সাধনায় মানুষকে দিয়েছেন প্রকৃত মুসলমান হওয়ার শিক্ষা।
হযরত মুহম্মদ (দঃ) থেকে হযরত আলী (আ:) এবং হযরত আলী (আ:)থেকে হাসান বসরী এই তালিম লাভ করেন। সিনা -ব-সিনায় চলে আসা এই তালিম হযরত ওসমান হারুনীও লাভ করেন। এই তালিমগুলো লিপিবদ্ধ ছিল না। হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) সুশৃঙ্খলভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে লিপিবদ্ধ করেন।
হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) ৬৩৩ হিজরীর ৫ রজব দিবাগত রাত অর্থাৎ ৬ রজব সুবহে সাদেকের সময় বেসালে হাকিকী গ্রহণ করেন। তখন তার বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। গরীবে নেওয়াজের বড় সাহেবজাদা হযরত খাজা ফখরুদ্দীন চিশতী (রহঃ) তার নামাজে জানাজায় ইমামতি করেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি হযরত খাজা কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার খাকী (রহঃ) কে খিলাফতের দায়িত্ব অর্পন করে সিলসিলার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন।
মহান রাব্বুল আলামীন আমাদের সকলকে গরীব নেওয়াজ (রাহ:) এর সোহবত নিয়ে দুনিয়াবি জিন্দেগী করার তৌফিক দান করুক আমিন।