বঙ্গনিউজবিডি ডেস্ক : সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় বিচার শুরু হয়েছে। সোমবার (২৩) সকাল সোয়া ১০টায় কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আলোচিত এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে বিচার কার্যক্রম শুরু করা হয়। টানা তিন দিন এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ করা হবে। এই তিন দিনে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আদালতে মামলার ৮৩ সাক্ষীর মধ্যে বাদীসহ ১৫ জনকে ডাকা হয়েছে।
কক্সবাজার আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম বলেন, প্রথমদিন মামলার বাদী সিনহার বোন শারমিন ফেরদৌসের সাক্ষ্যগ্রহণ ও তাকে জেরা করা হয়েছে। মঙ্গলবার (২৪ আগস্ট) একই সময় আবারও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে। সাক্ষ্যগ্রহণ আগামী ২৫ আগস্ট পর্যন্ত চলবে। এ সময় ১৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হবে।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলের আদালতে সোমবার সকাল সোয়া ১০টা থেকে শুরু হয়ে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত এ সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা চলে।
আলোচিত এ হত্যা মামলায় ৮৩ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। বাকিরা পর্যাক্রমে সাক্ষ্য দেবেন বলে জানান কক্সবাজার আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম। সাক্ষ্যগ্রহণের সময় ওসি প্রদীপ-লিয়াকতসহ এ মামলার ১৫ জন আসামি কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন।
আদালত সূত্রে জানা যায়, মামলার বাদী ও প্রধান সাক্ষী সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস আদালতকে বলেন- লিয়াকত ফোনে বলেছে, ‘টার্গেট ফেলে দিয়েছি, তোরা তাড়াতাড়ি আয়।’ আরেক ফোনে বলেন, ‘স্যার একটাকে ডাউন করেছি, আরেকটারে ধরে ফেলেছি।’ সিনহা পানি ও শ্বাস নিতে চাইলে লিয়াকত গালাগাল করে কোমরে লাথি মেরে ফেলে দেয় ও মাথা চেপে ধরে। এরপর পুলিশ আসলে লিয়াকত নির্দেশ দেয় আশপাশের মানুষকে ভয় দেখাতে, যাতে কেউ সিনহাকে সাহায্য করতে না পারে, ছবি বা ভিডিও করতে না পারে।
তিনি আরও বলেন, কিছুক্ষণ পর প্রদীপ আসে। কাকে যেন ফোন করে, লিয়াকতের সঙ্গে কথা বলে, সিনহার দিকে এগিয়ে যায়, তার বাম পাঁজরে সজোরে লাথি মারে। এরপর সে জুতা দিয়ে বাম গলা চাপ দেয়, তখন সিনহা নাড়াচাড়া করেন ও কাঁপতে থাকেন। একপর্যায়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে প্রদীপ গলা থেকে পা সরিয়ে নেয়। এরপর রুবেল সাগরকে বলেন, গাড়ি থেকে ইয়াবা, গাঁজা নিয়ে আসতে হবে। রাত ১২টার দিকে হাসপাতালে নেওয়া হলে ডাক্তার সিনহাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে আসামিরা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে দুটি মিথ্যা মামলা দায়ের করে ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে। লিয়াকত প্রদীপের প্ররোচনায় ও ফোনে নির্দেশিত হয়ে সিনহাকে গুলি করে। পরে প্রদীপ ঘটনাস্থলে গিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত ও তরান্বিত করেন। আদালতের কাছে চার্জশিটে বর্ণিত আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানাই।
এ সময় আদালতে কান্নায় ভেঙে পড়েন সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার। আদালত তাকে শান্ত হয়ে বসতে বলেন। শারমিন শাহরিয়ারের সাক্ষ্যগ্রহণের পর শুরু হয় জেরা। এ সময় আসামিপক্ষের আইনজীবীরা সিনহার অবসর গ্রহণ ও ইউটিউব চ্যানেলের বিষয়সহ বিভিন্ন প্রশ্ন করেন তাকে।
সিনহা হত্যার বিচারের রায়ের দিকে সারা বাংলার মানুষ তাকিয়ে আছে উল্লেখ করে ওসি প্রদীপ-লিয়াকতসহ হত্যাকাণ্ডে জড়িতের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন সিনহার বোন শারমিন ফেরদৌস।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। তার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলামকে (সিফাত) পুলিশ আটক করে। এরপর সিনহা যেখানে ছিলেন সেই নীলিমা রিসোর্টে ঢুকে তার অপর দুই সফর সঙ্গী শিপ্রা দেবনাথ ও তাহসিন রিফাত নুরকে আটক করে। পরে তাহসিনকে ছেড়ে দিলেও শিপ্রা ও সিফাতকে গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। এই দুজন পরে জামিনে মুক্তি পান।
সিনহা হত্যার ঘটনায় মোট চারটি মামলা হয়েছে। ঘটনার পরপরই পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি মামলা করে। এর মধ্যে দুটি মামলা হয় টেকনাফ থানায়, একটি রামু থানায়। ঘটনার পাঁচ দিন পর অর্থাৎ ৫ আগস্ট কক্সবাজার আদালতে টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৯ পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। চারটি মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় র্যাব।
২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও র্যাব-১৫ কক্সবাজারের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. খাইরুল ইসলাম।
আসামিদের মধ্যে পুলিশের ৯ সদস্য রয়েছেন। তারা হলেন, বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত আলী, এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, এএসআই লিটন মিয়া, কনস্টেবল সাফানুল করিম, রুবেল শর্মা, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন ও সাগর দেব নাথ।
অপর আসামিরা হলেন- আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্য যথাক্রমে এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজিব ও মো. আব্দুল্লাহ এবং টেকনাফের বাহারছড়ার মারিষবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও পুলিশের করা মামলার সাক্ষী নুরুল আমিন, মো. নিজাম উদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।
গ্রেফতারদের মধ্যে ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে ওসি প্রদীপ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি। এর আগে আসামিদের তিন দফায় ১২ থেকে ১৫ দিন রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল।