বঙ্গনিউজবিডি ডেস্ক: করোনাকালে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় অপ্রাপ্ত বয়সী অনেক ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। ২১ মাসে কুমিল্লার লাকসাম উপজেলায় বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে সংসার পেতেছে ৭৭৪ ছাত্রী।
বিদ্যালয়ের শিক্ষক, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ এমনকি পাড়া-প্রতিবেশীরাও এসব বিয়ের আগে খোঁজ পাননি। বিয়ে হওয়ার পরে তা জানাজানি হয়েছে। অপরদিকে বিয়ের আগে খবর পাওয়া গেলে প্রশাসনের উদ্যোগে তা বন্ধ করা হয়েছে।
কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলার আটটি ইউনিয়নের প্রায়ই গ্রামে দেদার হচ্ছে বাল্যবিয়ে। উপজেলা প্রশাসন বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করলেও কৌশলে এ বিয়ে সম্পন্ন করছে অভিভাবক মহল। এলাকার সচেতন ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতারা ও কতিপয় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের যোগসাজশে এসব বিয়ে হয়েছে।
ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রীরা এই বিয়ের শিকার হচ্ছে। আবার কেউ কেউ জন্ম নিবন্ধন সনদ জাল করে ভুয়া বয়স বাড়িয়ে নিচ্ছে। অনেকেই আবার এফিডেভিটের মাধ্যমে বিবাহ ঘোষণা করেই সম্পূর্ণ অবৈধভাবে সংসার করছে।
এসব নাবালিকা মেয়েরাই অল্প বয়সে সন্তান ধারণ করে নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এতে একদিকে ওই মেয়েদের চিকিৎসা করাতে পিতা বা স্বামীর হিমশিম খেতে হচ্ছে।অন্যদিকে, কয়েক বছর সংসার করার পর মেয়েরা নানাভাবে মানসিক, শারীরিক ও পাশবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ফলে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনাও বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে।
কোনো মেয়ে বিষপানসহ গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করছে। কিংবা হত্যার পর ফাঁস দিয়ে গাছে বা ঘরের আড়ার সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখছে এমন অভিযোগও রয়েছে।
আদমশুমারি রিপোর্ট ২০০১ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো লাকসাম উপজেলা ও বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সূত্রমতে, ৮টি ইউনিয়ন ও ১৯৪টি গ্রামে জনসংখ্যা ২ লাখ ৭৫ হাজার ৬৪৬ জন। গত বছর মার্চ মাস থেকে চলতি বছরে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২১ মাসে উপজেলার মুদাফরগঞ্জ (উঃ থেকে দঃ)ইউনিয়ন, লাকসাম পূর্ব ইউনিয়ন, বাকই ইউনিয়নসহ উপজেলার সর্বত্রই একের পর এক স্কুল পড়ুয়া নাবালিকা মেয়ের বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে।
এর মধ্যে করোনায় ২১ মাস ব্যবধানে উপজেলার রহমানির স্কুল ১১০, মুদাফরগঞ্জ স্কুল ৯৫ , আজকরা স্কুল ৯০, জালাল মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় ৬৪, গণউদ্যোগ বালিকা স্কুল ৫০, তোরাব আলী উচ্চ বিদ্যালয় ৪০, নরপাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ২০, অশ্বদিয়া আর্দশ উচ্চ বিদ্যালয় ৩০, বরইগাঁও বালিকা ৪৫, শ্রীয়াং উচ্চ বিদ্যালয় ৩০, উত্তরদা উচ্চ বিদ্যালয় ৩৫, ভাকড্যা উচ্চ বিদ্যালয় ৩২, কামড্যা উচ্চ বিদ্যালয় ২৭, গোবিন্দপুর উচ্চ বিদ্যালয় ২৮,রাজাপুর উচ্চ বিদ্যালয় ২০, জ্যোতিপাল মহাথেরু ১৫ ও ইছাপুরা সেন্ট্রাল ৩ জনসহ কমপক্ষে আট শতাধিক বাল্যবিবাহ ঘটেছে।
এসব বিয়ের সঙ্গে ইউনিয়নের কতিপয় কাজী বা পুরোহিতরাও জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। কিছু অভিভাবক মহল কৌশলে নিজ গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে নিয়ে খুব গোপনে বিবাহ সম্পন্ন করেছেন। প্রত্যেকটি গ্রাম ও মহল্লার পথে পথে সাইনবোর্ড দেয়া রয়েছে যে বাল্যবিবাহ মুক্ত ইউনিয়ন।
এ ছাড়াও বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন এনজিও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সভা, সমাবেশ, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি রয়েছে। এর পরও কোনোভাবেই মুক্ত হচ্ছে না এই বাল্যবিয়ে। বাল্যবিয়ের এই অভিশাপ থেকে কিশোরী মেয়েরা পরিত্রাণ পাচ্ছে না। শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে এই বিয়ের হার অনেক বেশি।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন বৃহত্তর কুমিল্লা আঞ্চলিক শাখার সভাপতি মাহমুদুল হাসান রোম্মান বলেন, কতিপয় ম্যারেজ রেজিস্ট্রার ও পুরোহিত মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময় সরকারি আইন উপেক্ষা করে এসব বাল্যবিয়ের কাজে সহযোগিতা করছেন। আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় এ ধরনের বিয়ে ঘটেই চলেছে। আবার অবৈধ কাগজ তৈরি করে ও নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে বিয়ে ঘোষণা হচ্ছে। যারা এই ধরনের ঘটনা ঘটায় তাদের কঠোর আইনের আওতায় আনলে অনেকটাই বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
লাকসাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম হিরা বলেন, বাল্য বিয়ের কারণে পারিবারিক কলহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, আত্মহত্যার মতো ঘটনা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া অকালে ঝরেপড়ে শিক্ষা জীবন থেকে। এটা একটা সামাজিক ব্যাধি। তাই সামাজিকভাবে তা প্রতিরোধ করতে হবে।
কথা হয় লাকসাম উপজেলা যুব নারী কল্যাণ সংস্থার কোষাধ্যক্ষ মারিয়া নুর জাহানারা ভূঁইয়া মুনমুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, করোনা মহামারি সারা বিশ্বে তাণ্ডব চালিয়েছে, যার ফলে সকল সেক্টরের ন্যায় শিক্ষা ক্ষেত্রে অধিক ক্ষতি হয়েছে, আর এই সুযোগে অসচেতন অভিভাবকগন অপ্রাপ্ত স্কুল কলেজে পড়ুয়া মেয়েদেরকে জোরপূর্বক বিয়ে দিয়েছেন এবং ছোট্ট ছোট্ট ছেলেদের বিভিন্ন কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। সমাজ পরিবর্তন ও সুশিক্ষিত জাতি গঠনে অভিভাবকদের আগে পরিবর্তন হওয়া উচিত।
রহমানির স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আবুল খায়ের বলেন, মূলত দুইটি কারণে এসব বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটছে। প্রথমত রাস্তায় বখাটেদের উৎপাত বৃদ্ধি, দ্বিতীয়ত কন্যাসন্তানের প্রতি অভিভাবকদের অবহেলা।
নুপুর নারী কল্যাণ সমিতি সভাপতি ও ব্র্যাকের নারী অধিকার বাস্তবায়ন নেত্রী নাজমুন্নাহার নুপুর বলেন, করোনার সময় অনেক অধ্যায়নরত ছাত্রীদেরকে অপ্রাপ্ত বয়সে অভিভাবকরা জোরপূর্বক বিয়ে দিয়েছেন। এর জন্য শতকরা ৮০ ভাগ দায়ী অভিভাবকরা। বাল্যবিবাহ একটি সামাজিক ব্যাধি। তাই অভিভাবকদের সচেতন হওয়া দরকার।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার প্রাসাদ কুমার ভাওয়াল বলেন, বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং ও মাদক বিষয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের সচেতন হওয়ার জন্য বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস শুরু হওয়ার পূর্বে শিক্ষকরা আলোচনা করবেন- এ বিষয়ে বলে দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মানসী পাল বলেন, আমরা বাল্যবিয়ের খবর জানলে সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। তবে এসব বিয়ে গোপনে বা রাতের আঁধারে অন্যত্র নিয়ে বিয়ে দিলে জানতে পারি না।