বঙ্গনিউজবিডি ডেস্ক: ইরান প্রবাসী ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক মুহাম্মাদ মুনীর হুসাইন খান বলেছেন, ইমাম খোমেনী (র.) এর বিশ্ব কুদস দিবসের ঘোষণার মাধ্যমে ইসরাইলকে পতনের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। ইসরাইলের মৃত্যু ঘণ্টা বেজে উঠেছে।
মরহুম ইমাম খোমেনীর মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে রেডিও তেহরানকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেছেন।
সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
রেডিও তেহরান: জনাব, মুহাম্মাদ মুনীর হুসাইন খান বছর ঘুরে এলো ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা মরহুম ইমাম খোমেনীর মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি একজন আলেম হয়েও আধুনিক রাজনীতিতে বিরাটভাবে শক্তিমান; জনগণ তার পেছনে প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। এই যে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা, একটা গণবিপ্লব সফল করা- এটা কীভাবে সম্ভব হলো?
মুহাম্মাদ মুনীর হুসাইন খান: আমার বক্তব্যের শুরুতে মরহুম ইমাম খোমেনী (র.) এর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি আন্তরিক শোক ও সমবেদনা। ইমাম খোমেনী(র.) ছিলেন একজন বিচক্ষণ, যোগ্যতাসম্পন্ন ফকিহ মুজতাহিদ আলেম। তিনি স্থান কাল পাত্র এবং যুগের প্রয়োজন সম্পর্কে ছিলেন জ্ঞাত। তিনি ইরানি জনগণ এবং মুসলিম উম্মাহর সমস্যার সাথে পরিচিত ছিলেন। ইসলামি আদর্শ ও নীতির উপর সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন। যে কারণে তাঁর উপর জনগণ আস্থা এনেছিল ও তাঁর অনুগত হয়েছিল। শাহ’র দুঃশাসনের ফলে একইসাথে ইরানের উপর সাম্রাজ্যবাদীদের আধিপত্যের কারণে দেশের জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে মুক্তির জন্য ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হন। তারা শাহ এবং তার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন। অবশেষে ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে জনগণের আন্দোলনে শাহ সরকারের পতন ঘটে। ইমাম খোমেনীর দৃঢ়তা, সততা একনিষ্ঠতা, বিচক্ষণতা, নেতৃত্ব দানের যোগ্যতা এবং জালিমদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ত্যাগ তিতিক্ষা জনগণকে স্বৈরাচারী শাহ সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে।
রেডিও তেহরান: ইমাম খোমেনীর ডাকে ইরানের জনগণ আড়াই হাজার বছরের রাজতান্ত্রিক শাসনকে উৎখাত করেছে। এ পর্যায়ে প্রশ্ন হচ্ছে- বিপ্লব পরবর্তী সময়ে জনগণের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাবটা কেমন?
মুহাম্মাদ মুনীর হুসাইন খান: দেখুন, ইরানি জনগণের প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তি সম্পর্কে বলতে গেলে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করা দরকার। ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের পর ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ফলে এখানে ধনি গরীব ব্যবধান বেশ কমে গেছে। যা শাহের আমলে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। সমগ্র ইরানে অবকাঠামোগত দিকের মৌলিক উন্নয়ন ঘটেছে। বিপ্লবের পর বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, পানি সরবরাহ ও রাস্তা ঘাট নির্মাণ ,যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, চিকিৎসা,কৃষি-খাদ্য, শিল্প, শিক্ষা ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছে এবং সে ধারা অব্যাহত রয়েছে। ইরানের উপর দীর্ঘমেয়াদে কঠোর অবরোধ আরোপ করে রেখেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকার সাথে পাশ্চাত্য মিলে ইরানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রও অব্যাহত রেখেছে। এত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও ইরানের ইসলামি শাসন ব্যবস্থা জনগণের কল্যাণের জন্য সবসময় সচেষ্ট রয়েছে। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কারণে অর্থনৈতিক সংকট ও বেকারত্ব থাকলেও দেশটির জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ইসলামি বিপ্লব এবং বিপ্লবী শাসন ব্যবস্থাকে আন্তরিকভাবে সমর্থন করে। ইরানের ভবিষ্যত সরকার ও প্রশাসনের কাছে দেশটির জনগণের প্রত্যাশা হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা ও বেকার সমস্যার সমাধান।
রেডিও তেহরান: বলা হয়- ইমাম খোমেনী বিশ্বের কথিত পরাশক্তিগুলোর ভীত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। কীভাবে সেটা সম্ভব হয়েছে এবং এ নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
মুহাম্মাদ মুনীর হুসাইন খান: ইরানের ইসলামি বিপ্লবের রূপকার ইমাম খোমেনী (র.) প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের ভীত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে শুধু মৌখিক প্রতিবাদ করেই ক্ষ্যন্ত হননি ইমাম খোমেনী (র.) ও ইরান। বরং দীর্ঘ আট বছর ধরে ইরানের উপর পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ চলাকালেও ইরান আফগান মুক্তি সংগ্রামে সর্বাত্মক সমর্থন ও সাহায্য করেছে। আর ইমাম খোমেনীর নির্দেশনায় ফিলিস্তিন ও লেবাননের জনগণের মধ্যে ইসরাইলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সফল প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠে। যার বাস্তব ফল বর্তমানে আমরা দেখছি।
ইমাম খোমেনী(র.) এর আরেকটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ হচ্ছে, তিনি রমজানের শেষ শুক্রবার বিশ্ব আল কুদস দিবসের ঘোষণা দেন। সেই ঘোষণার মাধ্যমে ইসরাইলকে পতনের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। তাই ইসরাইল এখন পতনোন্মুখ। তার মৃত্যুর ঘন্টা বেজে উঠেছে। ইরান গত চল্লিশ বছরের মধ্যে বিশেষ করে গত পনের বছরে আমেরিকার প্রভাবকে বহুলাংশে খর্ব করেছে। সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, আফগানিস্তান, ইয়েমেন, বাহরাইন তথা এ অঞ্চলে ইরানের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব অঞ্চলসহ বিশ্বে ইরানের নৈতিক প্রভাব অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে ইরানের ইসলামিক আদর্শিক কারণে বিপ্লবের প্রথম দিকেও যেভাবে পরাশক্তিগুলো ভীত কেঁপে উঠেছিল এখনও একইভাবে বর্তমানের পরাশক্তিগুলো যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাদেরও ভীত দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।
রেডিও তেহরান: জনাব, মুহাম্মাদ মুনীর হুসাইন খান ইরানের এই মহান নেতার কর্মময় জীবনকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মুহাম্মাদ মুনীর হুসাইন খান: ইমাম খোমেনী(র) একজন মহাপুরুষ। তার কর্মময় জীবনকে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আনা সম্ভব না। আমি গুরুত্বপূর্ণ দু তিনটে বিষয় তুলে ধরছি। আমরা ইমাম খোমেনীর কর্মময় জীবনকে তিনভাবে ভাগ করতে পরি।
প্রথমত ইমাম খোমেনীর শিক্ষকতা জীবন। তিনি একজন সফল শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ ছিলেন।
দ্বিতীয়ত-ইমাম খোমেনীর ধর্মীয় নেতৃত্ব, জনগণের ধর্মীয় বিষয়াদি ও কতৃত্ব- এই অধ্যায় থেকেই শুরু হয় তাঁর সংগ্রামী জীবন। ১৯৬৪ সালে শাহ’র ক্যাপিচুলেশন আইনের বিরুদ্ধে এবং তথাকথিত সাদা বিপ্লব নামে একটি বিপ্লব যে শাহ করতে চেয়েছিল তার বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ করেন ও সোচ্চার হন। জনগণ তখন ইমাম খোমেনীর প্রতিবাদে সাড়া দেয় এবং তীব্র আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৬৪ সালের ৩ জুন মোতাবেক ১৫ খোরদদ সমগ্র ইরানজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। জনতার সেই বিক্ষোভ স্বৈরাচারী শাহ সরকার নিষ্ঠুরভাবে দমন করে। এরপর ইমাম খোমেনীকে নির্বাসিত করা হয়। প্রথমে তাঁকে তুরস্কে পরে ইরাকের নাজাফ নগরীতে নির্বাসনে পাঠায় শাহ সরকার। সেখানে দীর্ঘ পনের বছর নির্বাসনে থেকে ইরানের ভেতরে ইসলামি বিপ্লবকে নেতৃত্ব দেন এবং ১ ফেব্রুয়ারি ইরানে প্রত্যাবর্তন করেন।
১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ইরানে ইসলামি বিপ্লব বিজয় লাভ করে। বিপ্লব বিজয় লাভের দিন থেকে ১৯৮৯ সালের ৩ জুন অর্থাৎ ইমাম খোমেনীর জীবনের শেষের দশ বছর একটি বিশেষ সময়কাল। এই দশ বছর সময়ে ইরান-ইরাক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তিনি নিজে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। তাঁর দিক নির্দেশনাগুলো ছিল খুবই কার্যকর। সেই যুদ্ধে ইরান বিজয়ী হয়। এই দশ বছরে ইমাম খোমেনী(র.) পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের বৈরীতাকে সাফল্যের সাথে মোকাবেলা করেন। ফলে পশ্চিমারা ব্যর্থ হন। অন্যদিকে নব্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড়ায়। ১৯৮৯ সালের ৩ জুন ৮৯ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান।
রেডিও তেহরান: তো জনাব মোহাম্মাদ মুনীর হুসাইন খান ইসলামি ইরানের রুপকার মরহুম ইমাম খোমেনীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলার জন্য আবারও আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
মোহাম্মাদ মুনীর হুসাইন খান : আপনাদেরওকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।