বঙ্গনিউজবিডি ডেস্ক : কোনো কাজ করার আগে সে কাজ সম্পর্কে জ্ঞান থাকা আবশ্যক। অন্যথায় কাজটি যথাযথ হয় না। সে হিসেবে কোরবানি করার আগে কোরবানিদাতাদের কোরবানির মাসআলা-মাসাইল সম্পর্কে জানা আবশ্যক।
কার ওপর কোরবানি ওয়াজিব : কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য শর্ত হলো-
১. নেসাব পরিমাণ তথা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মালিক হওয়া। যদি কোনো ব্যক্তি কোরবানির দিনসমূহের মধ্যে নেসাব পরিমাণ মালের মালিক হয়, তবে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হবে।
যার ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয় সে যদি কোরবানি করে তবে সাওয়াব প্রাপ্ত হবে ২. মুসলমান হওয়া ৩. মুকিম হওয়া, মুসাফির না হওয়া ৪. প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া ৫. বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া। দরিদ্র, অমুসলিম, মুসাফির এবং বিবেক বুদ্ধিহীন ও অপ্রাপ্ত বয়স্কের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয় (ফতওয়ায়ে শামী, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩১, কুদুরি, পৃ. ৩৪৩)।
কোরবানির সময় : জিলহজ মাসের ১০ তারিখ ঈদের নামাজের পর থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত কোরবানির সময়। তবে প্রথম দিন করা সর্বোত্তম, তারপর দ্বিতীয় দিন, তারপর তৃতীয় দিন।
ঈদের নামাজের পর কোরবানি করতে হবে, ঈদের নামাজের আগে কোরবানি করা বৈধ নয় (কুদুরি, পৃ. ৩৪৩, ৩৪৪)।
রাতে কোরবানি করার বিধান : কোরবানির তিন দিনের মধ্যে যে দু’টি রাত রয়েছে সেই দুই রাতেও কোরবানি করা জায়েজ, তবে রাতে করা মাকরূহ। কেননা, তখন হয়তো কোনো একটি রগ কাটা নাও হতে পারে। ফলে কোরবানি জায়েজ হবে না (আলমগীরি, ৫ম খণ্ড-পৃ.২৯৬)।
অন্যের দ্বারা কোরবানির পশু জবেহ করানোর বিধান : নিজ হাতে কোরবানির পশু জবেহ করা মুস্তাহাব। নিজে না পারলে অন্যের দ্বারা করানো যাবে। তবে নিজে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা উত্তম। নারীরা সম্ভব হলে পর্দা করে দাঁড়াবে (শরহে তানভীর, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩৪)।
জবেহকালে নিয়ত করা : নিয়ত বলা হয় অন্তরের ঐকান্তিক ইচ্ছাকে। ফলে কোরবানি পশু জবেহ করার সময় মুখে নিয়ত করা এবং দোয়া পড়া আবশ্যক নয়। অন্তরে কোরবানির খেয়াল করে মুখে শুধু ‘বিসমিল্লাহি ওয়াআল্লাহু আকবার’ বলে জবেহ করলে কোরবানি সহিহ হবে। অবশ্য জানা থাকলে কোরবানির পশু জবেহকালীন নির্দিষ্ট দোয়া পড়া উত্তম (শামী ২য় খণ্ড, পৃ. ২৭২)।
যেসব পশু দ্বারা কোরবানি বৈধ : ছয় ধরনের গৃহপালিত পশু দ্বারা কোরবানি জায়েজ। উট, গরু ও মহিষ এগুলোতে সাত শরিক পর্যন্ত জায়েজ। আর ভেড়া, ছাগল, দুম্বা এগুলোতে এক শরিকের বেশি জায়েজ নয়।
উট, গরু ও মহিষে একাধিক অংশীদার হলে, সবার অংশ সমান হতে হবে। কম-বেশি হলে কোরবানি শুদ্ধ হবে না। কয়েকজন মিলে এক নামের টাকা দিলে কোরবানি হবে না।
এক নামের টাকা একজনে দিতে হবে কয়েক ভাই মিলে পিতার নামে কোরবানি দিলে হবে না, সম্পূর্ণ টাকা একজন দিতে হবে। অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সা:-এর নামে কোরবানি দিলে টাকা একজন দিতে হবে (হেদায়া, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৪২২, আলমগীরি, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৬৯৫)।
পশু ক্রয় : কোরবানির পশুতে নিয়ত করতে হয় পশু ক্রয় করার সময়, জবেহ করার সময় নয়। ফলে কোরবানির দিন, কোরবানিদাতার অনুপস্থিতিতে অন্য কেউ জবেহ করলেও কোরবানি শুদ্ধ হবে।
একটি গরু ক্রয় করার আগেই সাতজন অংশীদার সবাই মিলিয়ে ক্রয় করা অতি উত্তম। আর যদি কেউ একা একটি গরু কোরবানির উদ্দেশে ক্রয় করে এবং মনে মনে এই ইচ্ছা পোষণ করে যে, পরে আরো লোক শরিক করে তাদের সাথে মিলে একত্রে কোরবানি করবে, তবে তাও জায়েজ আছে।
কিন্তু যদি গরু ক্রয় করার সময় অন্যকে শরিক করার ইচ্ছা না থাকে, একাই কোরবানি করার নিয়ত থাকে, পরে অন্যকে শরিক করার ইচ্ছা করে, তাহলে ক্রেতা গরিব হলে অন্যকে শরিক করতে পারবে না। আর যদি ক্রেতা ধনী হয়, তাহলে অন্যকে শরিক করতে পারবে (ফতোয়া হিন্দিয়া, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৩০৪)।
কোরবানির পশু হারিয়ে গেলে : কোরবানির পশু হারিয়ে বা চুরি হয়ে গেলে তৎপরিবর্তে আরেকটি ক্রয় করার পর তিন দিনের মধ্যে পূর্বেরটিও পাওয়া গেলে গরিবের উভয়টি জবেহ করতে হবে। আর ধনীর যেকোনো একটি জবেহ করলেই চলবে (আস আশবাওয়ান নাজাইর, ১ম খণ্ড, হেদায়া, ৪র্থ খণ্ড, পৃ.৪৩২)।
গোশত বণ্টন : যদি সাতজনে শরিক হয়ে একটি গরু কোরবানি করে, তবে গোশত অনুমান করে বণ্টন করবে না। বরং পাল্লা দ্বারা ওজন করে বণ্টন করবে। অবশ্য পা, মাথা, হাড় ইত্যাদি অনুমান করে বণ্টন করা বৈধ (দুররুল মুখতার, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩২)।
পশুর বয়স : উট পাঁচ বছর, গরু ও মহিষ দুই বছরের হওয়া আবশ্যক। ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা এক বছর হওয়া আবশ্যক। এর কম হলে কোরবানি শুদ্ধ হবে না। তবে ছয় মাসের দুম্বা যদি মোটাতাজা হয় এবং এক বছরের দুম্বার মতো দেখায়, তাহলে কোরবানি শুদ্ধ হবে (দুররুল মুখতার, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩২)।
যেসব পশু দ্বারা কোরবানি করা বৈধ নয় : কোরবানির জন্য পশু ত্রুটিম্ক্তু, দেখতে সুন্দর ও আকর্ষণীয় হওয়া আবশ্যক। যে পশুর দু’টি চোখ অন্ধ বা একটি চোখ পূর্ণ অন্ধ বা একটি চোখের এক-তৃতীয়াংশ বা আরো বেশি দৃষ্টি নষ্ট হয়ে গেছে, সে পশু দ্বারা কোরবানি শুদ্ধ হবে না। তদ্রুপ যে পশুর একটি কানের বা লেজের এক-তৃতীয়াংশ বা তদপেক্ষা বেশি কেটে গেছে সে পশু দ্বারা কোরবানি হবে না।
যে পশু এমন খোঁড়া যে, মাত্র তিন পায়ের ওপর ভর দিয়ে চলে, একটি পা মাটিতে লাগাতেই পারে না অথবা মাটিতে লাগাতে পারে, কিন্তু তার ওপর ভর দিতে পারে না, এরূপ পশু দ্বারা কোরবানি শুদ্ধ হবে না। খোঁড়া হলেও যদি পায়ের ওপর ভর দিয়ে চলতে পারে তবে কোরবানি বৈধ হবে।
পশু যদি এমন কৃশ ও শুষ্ক হয় যে, তার হাড়ের মগজও শুকিয়ে গেছে, তবে তা দ্বারা কোরবানি শুদ্ধ হবে না। যে পশুর একটি দাঁতও নেই, তা দ্বারা কোরবানি শুদ্ধ হবে না।
যদি যতগুলো দাঁত পড়ে গেছে তা অপেক্ষা অধিক সংখ্যক দাঁত বাকি থাকে, তাহলে কোরবানি শুদ্ধ হবে। যে পশুর জন্ম থেকে কান নেই, তা দ্বারা কোরবানি শুদ্ধ হবে না। কান আছে কিন্তু ছোট, তা দ্বারা কোরবানি শুদ্ধ হবে।
যে পশুর শিং উঠেনি বা ওঠার পর ভেঙে গিয়েছে, তা দ্বারা কোরবানি শুদ্ধ হবে। তবে মূল থেকে ভেঙে গেলে তা দ্বারা কোরবানি শুদ্ধ নয়।
অনুরূপ যে পশুর গায়ে বা কাঁধে দাঁদ বা খুজলি হয়েছে তা কোরবানি করা জায়েজ। তবে যদি খুজলির কারণে পশু বেশি কৃশ হয়ে যায়, তবে কোরবানি জায়েজ হবে না (আলমগীরি, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৪১৮, দুররুল মুখতার ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩৬, হেদায়া, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৪৩২)।
পশু ক্রয় করার পর অসুস্থ হলে তার বিধান : ত্রুটিমুক্ত পশু ক্রয় করার পর যদি এমন কোনো ত্রুটি দেখা দেয়, যে কারণে কোরবানি সহিহ হয় না, তবে ধনীর জন্য অন্য একটি পশু ক্রয় করে কোরবানি করতে হবে, আর গরিব হলে ত্রুটিপূর্ণ পশুই কোরবানি করতে হবে (দুররুল মুখতার, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩৩)।