যদিও ১৯৭৩ সালে ইয়ম কিপুর যুদ্ধের সময় আরবের তেল ও গ্যাস উৎপাদনকারী দেশগুলো ইসরায়েলকে সহায়তা করা দেশগুলোতে জ্বালানি বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে তারা গাজা নিয়ে তেমন কোনো কার্যকরী উদ্যোগই নেই নি।
দীর্ঘ ৭৫ বছর ধরে চলা ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংঘাতে ধারাবাহিকতায় গাজা রক্তাক্ত হচ্ছে। যে ধারা এখনও অব্যাহত। ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার হামলায় প্রতিদিন প্রাণ হারাচ্ছে শত শত মানুষ।
গাজা ইস্যুতে আরব দেশগুলোর যে ভূমিকা তা নিয়ে ফিলিস্তিনিদের হতাশার প্রকাশ ঘটেছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে। আল–জাজিরার রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা ফিলিস্তিন সংকট নিয়ে আরব দেশগুলোর ভূমিকাকে দুর্বল হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
এছাড়া ফিলিস্তিনি সাংবাদিক খালেদ আবু তোয়ামেহ আরবদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে প্রতারণা করার অভিযোগ করেছেন। আর ফিলিস্তিনি গবেষক মোহসেন মুহাম্মদ এবার আরব দেশগুলোর অবস্থানকে সবচেয়ে দুর্বল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ফিলিস্তিনি বুদ্ধিজীবী বড় অংশই আরব দেশগুলোর কাছে ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ আশা করেন।
উপসাগরীয় দেশগুলোর সহযোগিতা সংস্থার গালফ কোঅপারেশন কাউন্সিল–জিসিসিভুক্ত দেশগুলো ফিলিস্তিনের প্রতিবেশী। কিন্তু ইসরায়েলের হামলার পর শুধু সম্মেলন আর নিন্দা জানানো ছাড়া কোনো শক্ত পদক্ষেপ নেয়নি তারা। এই জোটের সদস্য সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন ও ওমান।
জিসিসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে প্রভাবশালী দেশ কাতার শুরু থেকেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সোচ্ছার। তারা ফিলিস্তিনের জন্য পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে ১৯৬৭ সালের আগের ভূখণ্ডকে সমর্থন করে। অন্যদিকে কুয়েতের সঙ্গে ইসরায়েলের কোনো সম্পর্ক নেই।
৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পেছনে ইসরায়েলকে দায়ী করার পাশাপাশি যুদ্ধবিরতির জন্য কাজ করে দেশটি। যুদ্ধ বন্ধে জন্য যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও হামাসের সঙ্গে যোগাযোগ করছে কাতার।
অন্যদিকে সৌদি আরব এবং ওমানের সঙ্গে ইসরায়েলের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই। শুধু বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক রয়েছে ইসরায়েলের।
গাজায় ইসরায়েলের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১১ নভেম্বর আরব–ইসলামিক সম্মেলনের আয়োজন করে সৌদি আরব। এতে আরব লিগের ২২টি দেশ ও ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) ৫৭টি দেশ অংশ নেয়। গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের নিষ্ঠুর হামলার নিন্দা জানান আরব ও মুসলিম দেশগুলোর নেতারা। একই সঙ্গে তারা গাজায় দ্রুত যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান। কিন্তু ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি তারা।
যদিও ওই বৈঠকে ইরান, সিরিয়া, লেবানন, আলজেরিয়াসহ কয়েকটি দেশ ইসরায়েল ও তার মিত্রদেশগুলোতে তেল রপ্তানি বন্ধ করার প্রস্তাব করেছিল। এ ছাড়া আরব লিগভুক্ত দেশগুলোকে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার প্রস্তাব দেয় তারা। কিন্তু এই প্রস্তাবে শুধু লিবিয়া সাড়া দেয়। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন এই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরবও ইসরায়েলের বিপক্ষে কঠোর কোনো বার্তা দেয়নি।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান গাজায় বর্বরোচিত হামলার জন্য ইসরায়েলকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র আখ্যা দেন। গাজায় ইসরায়েলের হামলাকে সমর্থন করায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের পশ্চিমা মিত্রদের সমালোচনা করেছেন তিনি।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও নাৎসি একনায়ক অ্যাডলফ হিটলারের মধ্যে ‘কোনো ফারাক নেই’ বলে মন্তব্য করেন এরদোগান।
গাজায় হামলার কারণে ইসরায়েল থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করেছে জর্ডান। কিন্তু মিসরসহ অন্যান্য আরব দেশ আগের মতোই ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে।
গত ২৩ নভেম্বর আরব লিগের অন্যতম সদস্যদেশ মরক্কোকে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান জানান হামাস নেতা খালেদ মেশাল। কিন্তু এ আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে উল্টো তাকে দোষারোপ করে মরক্কো সরকার।
অপর দিকে ইসরায়েলের হামলার কঠোর নিন্দা জানিয়ে আসছে ইরান। ইরানের সমর্থনপুষ্ট লেবাননভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা ফিলিস্তিনিদের ‘হত্যার বদলা নিতে’ বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ওআইসি বা আরব লিগের অনেক দেশ ইসরায়েল ইস্যুতে চুপ। অপর দিকে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া সোচ্চার হওয়ার মতো প্রভাবই নেই। তবে গত নভেম্বর ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার পরিস্থিতি তদন্তে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) আবেদন করেছে বাংলাদেশসহ পাঁচটি দেশ। বাংলাদেশ ছাড়াও রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা, বলিভিয়া, কমোরস ও জিবুতি। এসব দেশের মধ্যে শুধু বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ।
এদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সদস্য না হওয়ায় ইসরায়েল এই আদালতের বিচারিক ক্ষমতাকে স্বীকৃতি দেয় না। ফলে এই মামলার তেমন কোনো গুরুত্ব নেই।
সূত্র: রয়টার্স, আল-জাজিরা