দেশের আর্থিক খাতের এ দুর্বলতার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ঋণ আদায় কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর ডলার সঙ্কটের কারণে বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে। বিপরীতে বাজার থেকে টাকা চলে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে। পাশাপাশি কাক্সিক্ষত হারে আমানত আসছে না। সবমিলেই ব্যাংকগুলোর টাকার সঙ্কট বেড়ে যাচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ ও শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, প্রায় দুই বছর ধরে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে নানা সঙ্কট চলছে। ডলার সঙ্কট ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে চাপে রয়েছেন উদ্যোক্তারা। এ অবস্থায় নতুন বিনিয়োগ কমে গেছে। আবার ব্যাংকগুলো চাহিদা অনুযায়ী গ্রাহকের ঋণ বিতরণ করতে পারছে না। বিদেশী বিনিয়োগও খুব বেশি বাড়ছে না। ফলে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। বিবিএস প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেকার সংখ্যা বেড়ে ডিসেম্বরে হয়েছে সাড়ে ২৩ লাখ।
বাড়ছে খেলাপি ঋণ : ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, একশ্রেণীর রাঘব বোয়াল ব্যবসায়ী গ্রুপ ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ঋণ নিচ্ছেন। কিন্তু সেই অর্থের বেশির ভাগই আদায় করা যাচ্ছে না। এতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ও ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ বাড়ায় ব্যাংকগুলোর মুনাফার একটি বড় অংশ আটকে রয়েছে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে খেলাপি ছিল ১ লাখ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দেড় লাখ কোটি টাকা। দুই বছর তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। একই সময়ের ব্যবধানে প্রভিশন সংরক্ষণ ৬৬ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৮১ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। করোনার আগে থেকেই ঋণ পরিশোধে বিশেষ ছাড় দিয়ে আসছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। করোনার সময় তা আরও বেড়েছে। বৈশ্বিক মন্দার কারণে গত বছর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধে ছাড় ছিল। ফলে এখন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় বাড়েনি। ফলে নগদ আয় কমে গেছে।
ডলার বিক্রি করে বাজার থেকে টাকা উত্তোলন : গত দুই বছর যাবত ব্যাংকগুলোর ডলার সঙ্কটে ভুগছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আগে চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর ডলার জোগান দিতো। কিন্তু রিজার্ভ কমে যাওয়ায় এখন আর সব ব্যাংককে ডলার সরবরাহ করছে না। শুধু সরকারি বিশেষ কেনাকাটায় অর্থের জোগান দেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে ৭৬০ কোটি ডলার বিক্রি করে বিপরীতে ৭০ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে তুলে নেয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ হাজার ৩৫৭ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়। বিপরীতে ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে তুলে নেয়া হয়। অপর দিকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ১ হাজার ১৭০ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। বিপরীতে ১ লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়। যদিও এর বিপরীতে প্রতিনিয়তই ট্রেজারি বিল ও বন্ড বন্ধক রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকার জোগান দেয়া হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর টাকার সঙ্কটের এটিও একটি কারণ বলে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন।
কমছে বেসরকারি বিনিয়োগ : একদিকে ডলার সঙ্কটের কারণে ব্যবসায়ীদের কাক্সিক্ষত হারে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে পারছে না। অপর দিকে ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী ঋণও বিতরণ করা যাচ্ছে না। এর ফলে বেসরকারি খাতে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঋণপ্রবাহ বাড়ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ৯০ শতাংশ। ওই সময় পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে ৫ দশমিক ১১ শতাংশ, যা লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকের কম। আগামী জুন পর্যন্ত এ খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ১১ শতাংশ। গত মার্চ পর্যন্ত বেড়েছে ৭ দশমিক ০৭ শতাংশ, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৪ শতাংশ কম।
সরকারও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঋণ নিচ্ছে না : সংশ্লিষ্টরা জানিয়োছেন, আগে ব্যাংক থেকে সরকার অধিক মাত্রায় ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যেতো। কিন্তু চলতি অর্থবছরে এপ্রিল পর্যন্ত সরকারও বাজেট ঘাটতি অর্থায়নের জন্য কাক্সিক্ষত হারে ঋণ নেয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে চলতি অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। গত জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিয়েছে ২৪ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫ দশমিক ৩০ গুণ কম। একই সময়ে নন-ব্যাংক খাত থেকে নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৩ হাজার কোটি টাকা। জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিয়েছে ১১ হাজার ২০৭ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২ গুণ কম। এ হিসাবে দেখা যায়, মোট ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিয়েছে ৩৬ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার ৪ দশমিক ৩০ গুণ কম।
সরকার ও বেসরকারি খাত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ঋণ কম নিলেও ব্যাংক খাত এখন টাকার সঙ্কটে ভুগছে। তারল্য সঙ্কটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী বেসরকারি খাতে ঋণের জোগান দিতে পারছে না। এ দিকে উদ্যোক্তারাও অর্থনৈতিক অস্থিরতায় ডলারের সঙ্কট, ঋণের সুদের হার বৃদ্ধির কারণে নতুন ঋণ নিতে চাচ্ছেন না। ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সঙ্কোচিত হয়ে পড়ছে। এতে যেমন উৎপাদন কমে যাচ্ছে, তেমনি নতুন কর্মসংস্থানের গতিও থমকে গেছে। কিন্তু তার বিপরীতে প্রতি বছর শেষে কর্মক্ষম বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী চাকরির বাজারে যুক্ত হচ্ছেন। যাদের একটি বড় অংশই কাজ না পেয়ে বেকার থাকছেন। অর্থনীতির সঙ্কট ও বিনিয়োগ কমে যাওয়ার সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে কর্মসংস্থানে। বাংলাদেশ পরসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সম্প্রতিক পরিসংখ্যানেও কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। বিবিএস প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে দেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ১০ হাজার। এক বছরের ব্যবধানে সেই সংখ্যা ৪০ হাজার বেড়ে সাড়ে ২৩ লাখে উন্নীত হয়েছে।সূত্র : নয়া দিগন্ত