বঙ্গনিউজবিডি রিপোর্ট ঃ ডায়াবেটিস একটি হরমোন সম্পর্কিত রোগ। মানব দেহে ‘অগ্নাশয়’ নামে একটি অঙ্গ রয়েছে, যার একটি কাজ হলো ইনসুলিন হরমোন তৈরি করা। কোন কারণে এই অগ্নাশয় যদি চাহিদা মতো ইনসুলিন উৎপন্ন না করতে পারে কিংবা ইনসুলিন উৎপন্ন হচ্ছে কিন্তু তা কোন কাজ করতে পারছে না অর্থাৎ নিষ্ক্রিয় থাকছে তাহলে বুজতে হবে রোগীর ডায়াবেটিস হয়েছে।
ডায়াবেটিস একটি নীরব ঘাতক। এর জটিলতা পা থেকে মাথা পর্যন্ত। পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশে এই রোগে আক্রান্তের হার বেশি। রোগটি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সঠিক ধারণা কম। সারা বিশ্বে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত লোকের সংখ্যা ৫৩ কোটি। প্রযুক্তির ব্যবহার বেশি হওয়ায় শারীরিক পরিশ্রমের হার কমে গেছে। ফলে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী এই ঘাতক রোগে আক্রান্ত। বর্তমানে বাংলাদেশে ৪ কোটি ২৫ লাখ মানুষ ডায়াবেটিস রোগে ভুগছে। সতর্ক না হওয়ায় প্রতি ১১ জনে ১ জন এই রোগে আক্রান্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০৪৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা হবে ৬ কোটি ২৯ লাখ।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে যে লক্ষ্মণগুলো দেখা যায় : (১) ঘন ঘন প্রস্রাবের চাপ অনুভূত হওয়া এবং প্রস্রাব হওয়া। এজন্য অনেকে রোগটিকে ‘বহুমূত্র’ কিংবা ‘মধুমেহ’ রোগ বলে থাকে। রোগের এই অবস্থাকে ‘পলিইউরিয়া’ বলা হয়। (২) পিপাসা বা তৃষ্ণা বেড়ে যায়। এই অবস্থাকে বলে ‘পলিডিপসিয়া’। (৩) প্রচন্ড ক্ষুধা অনুভূত হয়।(৪) মিষ্টি জাতীয় খাবারের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। (৫) দৃষ্টি শক্তি কমে গিয়ে রোগী চোখে ঝাপসা দেখে। (৬) অনেক খাওয়ার পরও ওজন কমতে থাকে। (৭) শরীরে চুলকানি ও খোসপাঁচড়া হতে পারে। (৮) মহিলাদের যোনিতে ঘনঘন ইনফেকশন হতে পারে। (৯) আক্রান্ত ব্যক্তি স্নায়ুরোগে ভুগতে পারে। (১০) দূর্বলতা অনুভূত হয়। (১১) কাটা ক্ষত সহজে শুকায় না।
অনেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রথম দিকে উপরোক্ত লক্ষ্মণগুলো দেখা না-ও যেতে পারে। ২-৪ বছরের মধ্যে লক্ষ্মণগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। তবে পরীক্ষা করলে শুরুতেই তা নির্ণয় করা যায়, ফলে প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বনের সুযোগ তৈরি হয়।
ডায়াবেটিস কতো প্রকার ও কি কি?
বিজ্ঞানীরা ডায়াবেটিসকে প্রধানত ২ ভাগে ভাগ করেছেন। টাইপ-১ ডায়াবেটিস এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিস। টাইপ-১ ডায়াবেটিস: এই ধরনের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের অগ্নাশয়ের মধ্যে থাকা ইনসুলিন উৎপন্নকারী কোষগুলো ধ্বংস হয়ে যায়, ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণে ইনসুলিন উৎপন্ন হতে পারে না। এই কারণে বাইরে থেকে শরীরে ইনসুলিন প্রবেশ করাতে হয়। টাইপ-১ ডায়াবেটিস জেনেটিক কারণে হয়ে থাকে। HLDR-3 এবং HLDR-4 নামক ২টি জিনের কারণে টাইপ-১ ডায়াবেটিস হয়। ১০ থেকে ৩০ বছর বয়সের মধ্যে এই প্রকারের ডায়াবেটিস বেশি দেখা যায়।
টাইপ-১ ডায়াবেটিস আবার ২ প্রকার। টাইপ-১ এ ডায়াবেটিস, যা অটোইমিউনিটির জন্য বিটা কোষ ধ্বংসের মাধ্যমে হয়ে থাকে। টাইপ-১ বি ডায়াবেটিসও বিটা কোষ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণে হয়ে থাকে। তবে বিজ্ঞানীরা এখনো এ বিষয়ে সন্দিহান। টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর যে-সব সমস্যা হতে পারে : (১) ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস হতে পারে। (২) ননকিটোটিক হাইপারওসোমোলার কোমা হতে পারে। (৩) হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি। (৪) দীর্ঘদিন টাইপ-১ ডায়াবেটিসের ফলে স্ট্রোক হতে পারে। (৫) কিডনির কর্মক্ষমতা কমে গিয়ে এক সময় পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। (৬) পায়ে স্বাভাবিক রক্ত চলাচল হতে পারে না, ফলে পায়ের আলসার হয়ে থাকে। (৭) চোখে ঝাপসা দেখা, পরে এক সময় পুরাপুরি অন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। (৮) দীর্ঘদিন ধরে ইনসুলিন গ্রহণের ফলে শর্করার পরিমাণ কমে গিয়ে বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে।
টাইপ-১ ডায়াবেটিসের কোন প্রতিকার বা নিরাময় করার পদ্ধতি বিজ্ঞানীরা এখনো আবিষ্কার করতে পারেন নাই। তবে এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সুস্থ থাকার জন্য নিয়মিত ইনসুলিন গ্রহণ করতে হবে। ইনসুলিন ইনজেকশন অথবা পাম্প এর মাধ্যমে নেয়া যেতে পারে। তাছাড়া ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক ফ্যাট ও শর্করা জাতীয় খাবার পরিত্যাগ করতে হবে, নিয়মিত ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করতে হবে, নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হবে।
টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের অগ্নাশয়ের ভিতরের কোষগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে ইনসুলিন উৎপাদন করতে পারে না। কাজ করতে না-পারা ইনসুলিনকে বলে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স। সাধারনত ৪০ বছর বয়সের পর টাইপ-২ ডায়াবেটিস দেখা দিতে পারে। পৃথিবীতে প্রায় ৯০% রোগী টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
দীর্ঘদিন অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন, দীর্ঘদিন অতিরিক্ত মিষ্টি জাতীয় খাবার গ্রহণ, ট্রান্স ফ্যাটি এসিড ও স্যাসুরেটেড ফ্যাট অতিরিক্ত গ্রহণ, দীর্ঘদিন অতিমাত্রায় সাদা ভাত সাদা আটা সাদা চিনি গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম/পরিশ্রম না করা, অতিরিক্ত ওজন/মোটা হলে, কিংবা বংশগত কারণেও টাইপ-২ ডায়াবেটিস হতে পারে।
টাইপ-২ ডায়াবেটিসে যেসব সমস্যা হতে পারে : (১) নিরাময় অযোগ্য রোগ হওয়া বা আয়ু প্রায় ১০ বছর কমে যাওয়া, (২) হার্ট ও রক্তনালির বিবিধ রোগ হওয়া, (৩) হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়া, (৪) পায়ে রক্ত সঞ্চালন কমে গিয়ে অঙ্গহানির সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাওয়া, (৫) দৃষ্টি শক্তি কমে গিয়ে অন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাওয়া, (৬) কিডনির কার্যক্ষমতা কমে গিয়ে নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকা, (৭) স্মৃতি শক্তি কমে গিয়ে এক সময় লোপ পাওয়া, (৮) চিন্তা শক্তি কমে যাওয়া, (৯) যৌন শক্তি কমে যাওয়া, (১০) চর্মরোগে আক্রান্ত হওয়া, (১১) ঘনঘন ইনফেকশন হওয়া।
যে কোন ডায়াবেটিস নিরাময় যোগ্য রোগ নয়। তবে কিছু মেডিসিন গ্রহণ এবং লাইফ-স্টাইল পরিবর্তনের মাধ্যমে টাইপ-২ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। যেমন: (১) যথাযথ পুষ্টি গ্রহণ করতে হবে,(২) নিয়মিত ব্যায়াম/শরীরচর্চা করতে হবে,(৩) অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন পরিত্যাগ করতে হবে, (৪) খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন যেমন সাদা ভাত সাদা রুটি চিনি ও চিনি জাতীয় খাবার পরিত্যাগ করতে হবে, (৫) সরাসরি গ্লুকোজ গ্রহণ করা যাবে না, (৬) দেহে ভিটামিন ডি’র অভাব হতে দেওয়া যাবে না, (৭) সবুজ শাক-সবজি প্রচুর খেতে হবে, (৮) আলু/আলু জাতীয় খাবার গ্রহণ করা যাবে না, (৯) ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ করতে হবে।
মনে রাখতে হবে, অলস শরীরে খুব সহজেই ডায়াবেটিস বাসা বাধঁতে পারে। আর একবার ডায়াবেটিস হয়ে গেলে এর থেকে মুক্তির কোন পথ নাই। তবে রোগটি নিয়ন্ত্রণে রেখে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন যাপন করা যায়। বুঝেশুনে খাবার গ্রহণ ও নিয়মিত ব্যায়াম করা উচিত। ব্যায়ামের ক্ষেত্রে নামাজ একটি উত্তম পদ্ধতি আর খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনে রোজাও একটি সহায়ক অভ্যাস হিসাবে দীর্ঘদিন বিবেচিত হয়ে আসছে।
মনে রাখতে হবে, ডায়াবেটিস একটি নিরব ঘাতক। এর জটিলতা পা থেকে মাথা পর্যন্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীর অনেক দেশের চাইতে বাংলাদেশে এই রোগীর বৃদ্ধির হার বেশী। তাদের মতে রোগী যদি থ্রি-ডি পদ্ধতি অর্থাৎ ডায়েট,ডিসিপ্লিন, এবং ড্রাগ এই ৩টি বিষয় মেনে চলে তবে তারা সুস্থ জীবন যাপন করতে পারবে। সুখের বিষয় হলো, ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস হবে কি-না বিজ্ঞানীরা তার প্রযুক্তি আবিষ্কার করে ফেলেছেন। তারা বলছেন, রক্তে ‘ফলিস্টিন’-এর পরিমাণ বেশি পাওয়া গেলে ভবিষ্যতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি থাকে। আরো সুখবর শুনালেন ব্রিটিশ চিকিৎসক ডেভিড উনউইন। তিনি বলছেন, লো-কার্বোহাইড্রেট ডায়েট অভ্যাস করলে এমনিতেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ হয়ে যায়। তার মতে চিনি শস্য, মিষ্টি জাতীয় কার্বোহাইড্রেট গ্রহণের বদলে প্রতিদিনের চাহিদা মেটাতে প্রোটিন ও অক্ষতিকর চর্বি জাতীয় খাবার খেলে ডায়াবেটিস দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসবে।
গত ১৪ নভেম্বর ছিল বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। দিবসটি বিবিধ আলাপআলোচনা,দিক নির্দেশনামূলক সেমিনার সিম্পোজিয়াম, ইত্যাদির মাধ্যমে যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপিত হয়েছে। আসুন আমরা সবাই শুদ্ধ জীবনাচার অনুসরণের মাধ্যমে সুস্থ জীবন যাপন করি।
ড. হাবিবুর রহমান খান
বিশিষ্ট শিক্ষা ও জনসংযোগবিদ
এবং
সভাপতি, তর্কবাগীশ সাহিত্য পরিষদ