শুধু খুলনার আদালতেই নয়, গত ২৮ মে থেকে ২ জুন পর্যন্ত পঞ্চগড় জেলা ও দায়রা জজ কার্যালয়ে যোগদানকৃত ৩৪ জনের মধ্যে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নির্বাচনী এলাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা ও আখাউড়া উপজেলার ১৮ জন। সিরাজগঞ্জ আদালতে নিয়োগকৃত ৩৪ জন কর্মচারীর মধ্যে ২২ জনই ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লা জেলার। এ নিয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে দুদকে অভিযোগ করা হয়েছে। গত ২ অক্টোবর আইনজীবী মো. হুমায়ুন কবির বাদী হয়ে দুদক চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন।
অভিযোগে মো. হুমায়ুন কবির উল্লেখ করেছেন, ২০২২ সালে সিরাজগঞ্জ জজ আদালত ও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ-পূর্বক জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়। সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও সিরাজগঞ্জের উপরোক্ত তৎকালীন জেলা ও দায়রা জজদের যোগসাজশে নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি এবং আর্থিক লেনদেন হয়। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিয়োগ প্রদান করা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে এভাবে অনিয়মের মাধ্যমে সারা দেশের আদালতগুলোয় সাড়ে তিন থেকে চার হাজার লোক নিয়োগ করা হয়েছে। শুধু আদালতেই নয়, সাব-রেজিস্ট্রি অফিসেও বড় ধরনের ‘নিয়োগ-বাণিজ্য’ করেছেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। নিয়োগ-বাণিজ্যের পাশাপাশি করেছেন বদলি ও মামলায় তদবির-বাণিজ্য। নিয়োগ, বদলি আর তদবির-বাণিজ্যের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা কামিয়েছেন। এভাবে অবৈধভাবে অর্জিত টাকায় গড়েছেন নিজের ব্যাংক ‘সিটিজেন’। মন্ত্রীর এসব অপকর্মে সহযোগিতার জন্য গড়ে তুলেছিলেন একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে, এই সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা ছিলেন সাবেক আইন সচিব, মন্ত্রীর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দা ও আত্মীয় মো. গোলাম সারওয়ার। এ ছাড়া আরেক বড় সহযোগী ছিলেন মন্ত্রীর পিএস এম মাসুম। মন্ত্রীর সাবেক এপিএস রাশেদুল কায়সার ভূঁইয়া জীবন এবং পিএ আলাউদ্দিন বাবু ও শফিকুল ইসলাম সোহাগ। তারা সাবেক মন্ত্রীর ক্যাশিয়ার হিসেবেই কাজ করতেন।
মামলায় তদবির আর নিয়োগ ও বদলি-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মন্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণ করতেন আইনজীবী তৌফিকা করিম। তৌফিকা করিম মন্ত্রীর সুপ্রিম কোর্টের একই চেম্বারে কর্মরত এবং তার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। এই চেম্বারের আরও দু-তিন আইনজীবী মামলায় তদবির-বাণিজ্যে জড়িত ছিলেন। স্পর্শকাতর মামলায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন না পেলেও এই তদবির সিন্ডিকেটের প্রভাবে আসামিদের মিলেছে জামিন অধস্তন আদালত থেকে। এমনকি পেছনের দরজা দিয়ে জামিন দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। আর বিনিময়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া অভিযোগের তালিকায় নাম রয়েছে গাজীপুরের জেলা রেজিস্ট্রার সাবিকুন নাহারের। তার মাধ্যমেও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের নিয়োগ ও বদলি-বাণিজ্য হতো।
এরই মধ্যে দুদকের অনুসন্ধানে সাবেক আইন সচিব গোলাম সরোয়ারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ মিলেছে। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ কমিটিকে বাধ্য করে ঘুষের বিনিময়ে নিজ এলাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার ৪০০ থেকে ৫০০ লোক নিয়োগ দিয়েছেন। তাদের পরীক্ষার নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কখনো পরীক্ষার খাতা পরিবর্তন করা হয়েছে। আবার কখনো একজনের পরীক্ষা দিতে অন্যজনকে ব্যবহার করা হয়েছে। দুদকের মামলায় জামিন ও খালাস বাণিজ্যের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো আইনমন্ত্রী হন আনিসুল হক। এরপর থেকেই নিয়োগ, বদলি ও তদবির-বাণিজ্যে নেমে পড়েন। দ্বিতীয় মেয়াদে মন্ত্রী হওয়ার পর ২০২০ সালে ৪০০ কোটি টাকা জামানত এবং ২০০ কোটি টাকা চলতি মূলধন দিয়ে সিটিজেন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। তার মাকে প্রথমে এই ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান করা হয়। মায়ের মৃত্যুর পর বহুল আলোচিত তৌফিকা করিমকে চেয়ারম্যান করা হয়। এখানেই শেষ নয়, ‘প্রাইভেট একটি টেলিভিশনে ৪০ ভাগ শেয়ার আছে তার। এই তৌফিকা করিমই ছিলেন আনিসুল হকের চালিকাশক্তি। তিনি যা বলতেন তাই করতেন আনিসুল হক। তৌফিকা করিমের কানাডায় বাড়ি রয়েছে। সেখানে তার ছেলে ও মেয়েরা থাকেন। ধারণা করা হচ্ছে, ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর তৌফিকা করিম সেখানেই পালিয়েছেন।
এদিকে ১০ বছরের ব্যবধানে সাবেক আইন, বিচার ও সংসদবিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হকের নগদ টাকা বেড়েছে ২১৮ গুণ। ফুলেফেঁপে যেন ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হয়েছেন। ১০ বছর আগে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তিনি তার কাছে ৫ লাখ টাকা রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। অথচ ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তিনি উল্লেখ করেন, তার কাছে নগদ আছে ১০ কোটি ৯২ লাখ ৯৪ হাজার ১৯৯ টাকা, যা ১০ বছর আগের তুলনায় ২১৮ গুণ বেশি। তার জমা দেওয়া হলফনামা থেকে জানা যায়, আনিসুল হকের অস্থাবর সম্পদের মধ্যে বন্ড, ঋণপত্র, স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয়—এমন কোম্পানির শেয়ার হিসেবে তিনি সিটিজেন ব্যাংক ও এক্সিম বাংলাদেশের শেয়ার মূল্য উল্লেখ করেন ৪০ কোটি ১০ লাখ টাকা। দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তার নিজ নামে কোনো শেয়ার নেই উল্লেখ করেছিলেন। আনিসুল হকের কাছে নগদ ইউএস ডলার আছে ১৪ হাজার ৯৩ দশমিক ৫৮ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় সাড়ে ১৫ লাখ টাকা। পোস্টাল, সেভিংস সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র বা স্থায়ী আমানতে তার বিনিয়োগ রয়েছে ৫ কোটি ৭৯ লাখ ২৪ হাজার ৮৯৮ টাকা। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় এ খাতে তার কোনো বিনিয়োগ ছিল না এবং একাদশে ১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ ছিল বলে উল্লেখ করেন। ১০ বছর আগে কৃষি খাত (মৎস্য) থেকে আনিসুল হকের বার্ষিক কোনো আয় ছিল না। তবে গত পাঁচ বছর আগে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় এই খাতে তার বার্ষিক আয় ৩ কোটি টাকার বেশি দেখিয়েছিলেন। এ বছর এই খাতে আয় দেখিয়েছেন ৪৩ লাখ টাকা। তার আয়ের বড় অংশ আসে ব্যাংক ও এফডিআরের সুদ এবং কৃষি ও মৎস্য খাত থেকে। এই দুটি খাত থেকে তার বার্ষিক আয় হয় ৮৬ লাখ ৪৫ হাজার ৩৪৮ টাকা।
১০ বছর আগে আনিসুল হকের নামে কোনো সঞ্চয়পত্র, মৎস্য খামার, অকৃষিজমি ও স্বর্ণ ছিল না। বর্তমানে তার প্রয়াত মায়ের নামে ১ লাখ ৬৫ হাজার ৬০০ টাকার সঞ্চয়পত্র, তিনটি পৈতৃক মৎস্য খামার, ৩২ লাখ টাকার অকৃষিজমি ও ২০ ভরি স্বর্ণ রয়েছে। আনিসুল হকের স্থাবর সম্পদের মধ্যে নিজ নামে ৮ বিঘা কৃষিজমি রয়েছে, যার মূল্য ১৬ লাখ টাকা। দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায়ও একই পরিমাণ কৃষিজমির কথা উল্লেখ করেন তিনি। রাজধানীর পূর্বাচলে তার একটি প্লট রয়েছে, যার মূল্য ২৫ লাখ ৫১ হাজার ৮৫৮ টাকা। এ ছাড়া বনানীতে একটি বাড়ি, যার মূল্য ৪৫ লাখ টাকা এবং দুটি ফ্ল্যাট, যার মূল্য ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। তবে সাবেক এই মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠরা বলছেন, হলফনামায় আনিসুল হক যে সম্পদের তথ্য দিয়েছেন, তার প্রায় হাজার গুণ সম্পদ বেশি রয়েছে।
জানা গেছে, আনিসুল হকের অবৈধ উপার্জনের প্রধান উৎস ছিল নিয়োগ-বাণিজ্য। এমন কোনো আদালত ও সাব-রেজিস্ট্রি অফিস নেই, যেখানে তার নির্বাচনী এলাকা কসবা-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোক নিয়োগ পায়নি। ২০২৩ সালের মে মাসে তার এলাকায় এক অনুষ্ঠানে আনিসুল হক বলেছিলেন, ‘কসবা ও আখাউড়া উপজেলার ১ হাজার ৪৮৬ শিক্ষিত বেকার যুবককে আমি সরকারি চাকরি দিয়েছি এবং ৭শর বেশি লোককে নকলনবিশ বানিয়েছি।’ তবে সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আদালত ও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে কসবা-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রায় চার থেকে সাড়ে চার হাজার লোক নিয়োগ হয়েছে। মন্ত্রীর তদবির-বাণিজ্যে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে ছিলেন নিয়োগদাতারাও। অনেক আদালতে দীর্ঘদিন নিয়োগ বন্ধ রাখার ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু কাজ হয়নি। সাবেক এই আইনমন্ত্রীর চাহিদা মোতাবেক নিয়োগ দিতে হয়েছে। এই নিয়োগ-বাণিজ্যে আদালত অঙ্গনে সহযোগিতা করেন সাবেক আইন সচিব। আরেক সরকারি কর্মকর্তা সাবেক এই মন্ত্রীর পিএস (ব্যক্তিগত সহকারী) এম মাসুম সরকারি কর্মকর্তা হয়েও আনিসুল হকের পক্ষে ভোটের মাঠে নেমে পড়েন। দলীয় কর্মিসভায় যোগদান করেন। মূলত মন্ত্রীকে সন্তুষ্ট করিয়ে কাজ বাগিয়ে নেওয়াই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। পিএস মাসুমের এলাকা দিনাজপুরের অনেক লোকজন নিয়োগ পেয়েছেন সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে।
সূত্র জানায়, নিয়োগ-বাণিজ্যের পাশাপাশি আনিসুল হকের টাকা কামানোর আরেকটি উপায় ছিল সাব-রেজিস্ট্রার বদলি। স্থানভেদে ৪০ লাখ থেকে শুরু করে ৫০-৬০ লাখ, এমনকি দেড় থেকে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে সার-রেজিস্ট্রার বদলিতে। যে বেশি টাকা দিত তাকেই ভালো জায়গায় পোস্টিং দেওয়া হতো। তেজগাঁও রেজিস্ট্রি কমপ্লেক্সে খিলগাঁও, উত্তরা, বাড্ডা, পল্লবী, গুলশান, শ্যামপুর, মিরপুর, সাভার, রূপগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ এসব স্থানে বদলির জন্য একেকজন সাব-রেজিস্ট্রারকে ২ কোটি টাকার ওপরে দিতে হয়েছে। সাব-রেজিস্ট্রার ছাড়াও বিচারাঙ্গনের লোকজনও ভালো পোস্টিংয়ের জন্য ধরনা দিয়েছেন পিএ বাবু আর সোহাগের কাছে। মন্ত্রীর সাবেক এপিএস রাশেদুল কাওসার ভূঁইয়া জীবন কসবা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হয়ে এলাকায় চলে আসার পর বাবু হয়ে ওঠেন মন্ত্রীর সবকিছুর হর্তাকর্তা। ২০১৮ সালে পিএ নিয়োগ হওয়ার পর বাবুর অন্যরূপ বেরিয়ে আসতে শুরু করে। এদিকে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর আনিসুল হক কারাগারে রয়েছেন। আর অন্যরা রয়েছেন পলাতক। ফলে এসব নিয়োগ-বদলি ও তদবির-বাণিজ্যের ব্যাপারে তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
জানতে চাওয়া হলে দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ও দুর্নীতি বিরোধ সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এভাবে এলাকার লোকজনকে নিয়োগ দিয়ে মন্ত্রী দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। এ ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। প্রতারণা, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও মন্ত্রীর শপথ লঙ্ঘনের মতো ঘটনা ঘটেছে। তিনি আরও বলেন, মন্ত্রী হিসেবে সে অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী হয়ে কাজ না করার যে শপথ নিয়েছিলেন, তা তিনি লঙ্ঘন করেছেন। রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করার জন্য এলাকার লোকজনকে নিয়োগ দিয়ে অঞ্চলপ্রীতি করেছেন। মন্ত্রী হিসেবে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। এ ছাড়া মন্ত্রীর একার পক্ষে এসব কাজ করা সম্ভব হয়নি। মন্ত্রীর পাশাপাশি এসব নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি যারা নিয়োগ পেয়েছেন তারাও ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। যদি কোনো অযোগ্য লোক এভাবে প্রভাব খাটিয়ে অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ পেয়ে থাকে, তাহলে তা যাচাই-বাছাই করে দেখে আইনের আওতায় আনতে হবে।