বঙ্গনিউজবিডি রিপোর্ট : নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ মনোনিত প্রার্থী ডাঃ সেলিনা হায়াত আইভি দলীয় প্রতিক “নৌকা” আর স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার পেয়েছেন “হাতি” প্রতিক। প্রতিক বরাদ্দ পেয়ে প্রধান ২ প্রার্থী নারায়ণগঞ্জ শহরে বিশাল শোডাউন করেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী ডাঃ আইভি আশা প্রকাশ করে বলেন, নারায়ণগঞ্জ বাসী আবারো নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আমাকে জয়যুক্ত করবেন। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী এড.তৈমুর বলেন, আমি মানুষের ভালোবাসায় প্রার্থী হয়েছি। জনগন আমার সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ বাসীর চাহিদা আশা আকাঙ্খার প্রতি আমাকে সচেতন থাকতে হয়।
এদিকে রিটার্নিং কর্মকর্তা মাহফুজা আক্তার নির্বাচন আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে মেয়র পদে প্রধান ২ প্রার্থী ডাঃ আইভি এবং এড. তৈমুরকে শোকজ করার কথা নিশ্চিত করেছেন। সিটি কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার থেকে পর পর ২ বার মেয়র নির্বাচিত হওয়ায় ডাঃ আইভি’র অবস্থান অনেকটাই দৃঢ়। সৎ ও দূর্নীতি মুক্ত চরিত্র এবং নিজ শহরে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার কারণে তিনি দলীয় সমর্থনসহ সাধারণ ভোটার এবং প্রায় ৭০ হাজার নারী ভোটারের নিকট তার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। সে বিবেচনায় তিনি অনেকটা ফুরফুরে মেজাজে নিজ নির্বাচনী ক্যাম্পেইন চালিয়ে যাচ্ছেন।
কিন্তু জনশ্রুতি রয়েছে যে, নারায়ণগঞ্জের সার্বিক রাজনীতিতে নেতৃত্ব দানকারী ৩ পরিবারের মধ্যে ভূইয়া পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রমিজউদ্দিন আহমেদ ভূইয়ার উত্তরাধিকারীরা বর্তমান রাজনীতির ময়দানে অনেকটাই নিস্প্রভ। এই পরিবারের ২য় প্রজন্মের ব্যক্তিবর্গ প্রয়াত পিতার গৌরবোজ্জ্বল রাজনৈতিক ও পারিবারিক ঐতিহ্যের বিন্দু মাত্র সংরক্ষণ করেন না। রাজনীতির প্রতি অনিহা কিংবা অযোগ্যতা তাদেরকে নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে যোজন যোজন দূরে ঠেলে ফেলে দিয়েছে। তারা বরং নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের আওয়ামী সাংসদ শামীম ওসমানের ‘খেলা হবে’ মারাত্মক রাজনৈতিক কৌশলের ভয়ে রীতিমতো কম্পমান।
ভীতি তাদেরকে এতোটাই গ্রাস করেছে যে, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার বৈবাহিক সূত্রে ভূইয়া পরিবারের সাথে সম্পৃক্ত আওয়ামী লীগ জাতীয় কমিটির সদস্য এডভোকেট আনিসুর রহমান দীপু-কে প্রকাশ্যে সমর্থন প্রদানতো দূরের কথা পারিবারিক বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানগুলোতে নিমন্ত্রণ জানতেও ভয় পান্। পাছে যদি শামীম দাদা রুষ্ট হোন্, তাহলে উপায় কিছু থাকবে না। এতোকিছুর পরেও শেষ রক্ষা কিন্তু হয় নাই। নারায়ণগঞ্জ ওয়ার্ড-৮ এর আইভি গ্রুপের কাউন্সিলর প্রার্থী রুহুল আমীন মোল্লাকে সক্রিয় সমর্থন এবং নিজ চাচাতো বোন সংরক্ষিত মহিলা আসনের প্রার্থী নওরিনের নির্বাচনী সময়ন্বকের দায়িত্ব পালনের অভিযোগে শামীম ওসমানের সমর্থক প্রার্থী সালাউদ্দিন আহমেদ লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে প্রয়াত রমিজউদ্দিন আহমেদ ভূইয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র এনামুল হক ভূইয়া বাদলকে মারাত্মক ভাবে আহত করে। বিষয়টি স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করলেও খেলা হবে শামীম ওসমানের ভয়ে কেউ মুখ খুলছে না। যথারীতি ভূইয়া পরিবারের সদস্যরাও চুপ মেরে গেছে।
সন্ত্রাস নির্ভর ‘খেলা হবে’ রাজনীতির প্রবর্তক শামীম ওসমান তথা ওসমান পরিবার এজন্য ভূইয়া পরিবার নিয়ে মোটেই চিন্তিত নয়। তাদের সার্বিক টেনশন এখন চুনকা পরিবার তথা ডাঃ সেলিনা হায়াত আইভি-কে কেন্দ্র করে। সেলক্ষ্যে বরাবরের ন্যায় এবারো অনেকটা প্রকাশ্যেই তারা ডাঃ আইভি’র বিরুদ্ধে মাঠে নেমে পড়েছেন। জনশ্রুতি রয়েছে যে, এড. তৈমুর দলীয় সীদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে মেয়র পদে নির্বাচন করতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু খেলা হবে শামীম ওসমানের নৈতিক, আর্থিক ও জনবল সম্পর্কিত সক্রিয় সমর্থনের কারণে তিনি নাসিক নির্বাচনে মেয়র পদে লড়বার সীদ্ধান্ত নিয়েছেন। অনেকটা কাকতালীয় ভাবে তার নির্বাচনী সমাবেশগুলোতে প্রচুর জনসমাগম হতে শুরু করে। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে গনজোয়ার দেখা দিলেও ভোটাররা এড. তৈমুরকে নিরাপদে ভোট দিতে পারা নিয়ে আশংকিত। এতদ বিষয়ে এড. তৈমুর গণমাধ্যমকে বলেন, নাসিক নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি-না তা নির্ভর করছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপর। এতে নির্বাচন কমিশনের কোন ক্ষমতা নাই।
এড.তৈমুরের জনসমাবেশগুলোতে ভোটারদের ব্যাপক উপস্থিতির কারণে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নতুনভাবে চিন্তা ভাবনা শুরু করেছেন। নারায়ণগঞ্জ বিএনপির আহ্বায়ক পদ থেকে এড.তৈমুরকে সরিয়ে দেওয়ার পর পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিবেচনা করে এখন তাকে সমর্থন করার সীদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় বিএনপি।গত ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এটিএম কামালকে মোবাইলে ফোন করে মির্জা ফখরুল বলেন, পরিবেশ পরিস্থিতিতে জনগণের দাবির মুখে এড. তৈমুর প্রার্থী হয়েছেন। তিনি বিজয়ী হলে জনতার বিজয় হবে। এদিকে এড. তৈমুরের একটি মন্তব্য নারায়ণগঞ্জ বাসীর মধ্যে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেছেন যে তার কথা শুনলে ডেভিড মারা যেতো না। মানুষ মনে করছে ডেভিডের মৃত্যুতে এড. তৈমুরের একজন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর বিদায় করা গেলো। এদিকে দ্বিধা বিভক্ত নারায়নগঞ্জ আওয়ামী লীগে ঐক্য ফিরিয়ে আনতে দলীয় শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশে গঠিত একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গত ২০ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখ দলের ধানমন্ডিস্থ কার্যনির্বাহী অফিসে একটি সমন্বয় সভার আয়োজন করে আইভি গ্রুপ ও শামীম গ্রুপকে সেখানে আমন্ত্রণ করে। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আযম, আবদুর রহমান, বাহাউদ্দীন নাসিম প্রমূখ। ডাঃ আইভির নেতৃত্বে তার গ্রুপের লোকজন উক্ত সভায় উপস্থিত থাকলেও শামীম ওসমান তার দলবল নিয়ে যথারীতি অনুপস্থিত ছিলেন। সভা চলাকালীন সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ফোন করে সবাইকে নৌকা প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার নির্দেশনা প্রদান করেন।
পরবর্তীতে গত ২৪ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখ নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত মুজিব শতবর্ষ ও বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে জনসভায় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সভাটি এক পর্যায়ে ডাঃ আইভির নির্বাচনী সমাবেশে পরিনত হয়। এই সমাবেশেও সাংসদ শামীম ওসমান তার দলবল নিয়ে অনুপস্থিত ছিলেন। বিষয়টি কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ মোটেই ভালো ভাবে নেয় নাই। তারই ফলস্বরূপ নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের শামীম সমর্থক সহসভাপতি রবিউল আলমে তার দল বিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে। উদ্দেশ্য হলো খেলা হবে শামীম ওসমানকে সতর্ক করা। জানা যায়, শামীম ওসমান এসব সতর্ক বার্তাকে বিন্দু মাত্র পাত্তা দিচ্ছেন না। তার এক কথা, নেত্রী যদি তাকে সরাসরি ডাঃ আইভির পক্ষে কাজ করতে বলেন তাহলেই কেবল তিনি আইভির পক্ষে কাজ করবেন। নচেৎ নয়। শামীম ওসমান এ জাতীয় কার্যকলাপ নারায়ণগঞ্জ বাসীর মনে একটি প্রশ্নের উদ্রেক করেছে, শামীম ওসমানের খুটির জোর কোথায়? এতদ বিষয়ে এই প্রতিবেদক তার একজন সমর্থককে প্রশ্ন করলে তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শামীম দাদা হাজার কোটি টাকার মালিক। প্রয়োজনে তিনি টাকা বিলিয়ে ১০-১২ জন নেতা কিনে ফেলতে পারবেন। তার কিছু হবে না। তিনি যে টাকা পয়সা কামাই করেন তাতো আর একা খান্ না, দিয়েথুয়ে খান। তার চিন্তা কি? কানাডাসহ কয়েকটি দেশে তার প্রচুর বিষয়-সম্পত্তি রয়েছে। তার ক্ষমতা অনেক। পুলিশ-র্যাবকেও তিনি ছেড়ে কথা বলেন না। এর প্রমান ভুরিভুরি।
গত ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখ রাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা মোবাইল ফোন ডাঃ আইভি’র নির্বাচনি প্রচারাভিযানের খোঁজ খবর করেন। এতে ডাঃ আইভি ও তার সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক বোদ্ধা মহলের মনে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তাহলো, ডাঃ আইভি’র হার-জিতে খেলা হবে শামীম ওসমানের লাভ-ক্ষতি কি? মানুষ মনে করছে শীর্ষ নেতৃত্বের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে খেলা হবে শামীম ওসমান নিজ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে একটি বড় রিক্স নিয়ে ফেলেছেন। খেলতে খুব শামীম ওসমান কেন আইভি-কে নারায়নগঞ্জের রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে বিদায় করতে চাচ্ছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে অনেক নারায়ণগঞ্জ বাসী এই প্রতিবেদককে যা বলেছেন, ভূইয়া পরিবার স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়েছে। বাকী থাকে চুনকা পরিবার। এই চুনকা পরিবার তথা ডাঃ আইভি-কে রাজনীতি থেকে বিদায় করতে পারলে খেলা হবে শামীম ওসমান তথা ওসমান পরিবারের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে নারায়ণগঞ্জ জেলা রাজনৈতিক ও আর্থিক অঙ্গনে। কিন্তু বিষয়টি কতটুকু বাস্তবসম্মত!!! এ বিষয়েও আলোচনা কম হচ্ছে না। ডাঃ সেলিনা হায়াত আইভি যদি টানা ৩য় বারের মতো নাসিক চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতে পারেন তাহলে তিনি নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে এক ‘পলিটিক্যাল হিমালয়’ হিসেবে আবির্ভুত হবেন। সেখানে খেলা হবে শামীম ওসমান কিংবা ওসমান পরিবার মূষিক তুল্য বিবেচিত হবেন। ওসমান পরিবারের রাজনৈতিক বিদায় ঘটলেও আশ্চর্যের কিছু হবে না। আর যদি ডাঃ আইভি হেরে যান তাহলে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ, নারায়ণগঞ্জ জেলার আওয়ামী নেতৃবৃন্দ ও সাধারণত সমর্থক সবাই এই হারের জন্য খেলা হবে শামীম ওসমান ও তার পরিবারকে দায়ী করবেন। সেক্ষেত্রেও তার এবং ওসমান পরিবারের রাজনৈতিক মৃত্যু হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকবে।
খেলতে খুব পছন্দ করেন খেলা হবে শামীম ওসমান। ইতিমধ্যে তিনি রাজ্যময় (নারায়ণগঞ্জ জেলায়) ঢেড়া পিটিয়ে দিয়েছেন, আগামী ০৯ জানুয়ারি মাসদাইর মাঠে জনসভা হবে। তার পাইক-পেয়াদাদের কঠোর নির্দেশনা প্রদান করেছেন, সভায় পাঁচ লক্ষ লোকের সমাগম হতে হবে। পাইক-বরকন্দাজরাও নিজ নিজ এলাকায় এলান জারী করেছেন ০৯ জানুয়ারি দোকান-পাট, ব্যবসায় বানিজ্য, অফিস-আদালত, কলকারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব বন্ধ থাকবে। খেলা হবে শামীম ওসমানের জনসভায় উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। উক্ত জনসভায় তিনি তার চিরাচরিত টেকনিক মোতাবেক বলবেন, নেত্রীর সাথে আমার কথা হয়েছে, কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে কথা হয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে আমার কথা হয়েছে, আমার কাছে খবর আছে নারায়ণগঞ্জ জেলায় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নারায়ণগঞ্জ জেলায় জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা করছে। জঙ্গি গোষ্ঠীকে প্রতিহত করতে হবে। আর সেলক্ষ্যে নৌকা মার্কার বিজয়ের বিকল্প নাই। ডাঃ আইভি কোন ফ্যাক্টর নয়, ফ্যাক্টর হলো নৌকা মার্কা। আসুন সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে আমরা নৌকা-কে বিজয়ী করি। এক্ষেত্রে তিনি তার বাবা-মায়ের কবরে রহস্যজনক শ্মশানের মাটি ফেলার কাহিনি ভুলে যাবেন। আর এড. তৌমুরকে বানাবেন বলির পাঠা।