বঙ্গ নিউজ বিডি প্রতিনিধি : ফটো সাংবাদিক লুৎফর রহমান ১৯২৬ সালে মুর্শিদাবাদে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী আগামী শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪।
ব্রিটিশ ভারতের শেষের দিকে রয়াল ওয়ারফোর্সে ছোট একটা সৈনিকের চাকুরীর সুবাদে একদিন এক বৈমানিক বললো— তোমার ধুতি পাঞ্চাবিটা পরে একটা ছবি তুলতে চাই। আমার ছবিটা তুলবে তুমি, বলে তাঁর ১২৭ বেবী ব্রাউনি ক্যামেরাটা তুলে দিল আমাকে, তখন ১৬ বছরের উদ্দাম যুবক। কোন ইংরেজ সাহেবকে সরাসরি না বলার দুঃসাহস কোন বাঙ্গালীর ছিল না। আমি বিনয়ের সাথে বলি—আমি আমার ধুতি পাঞ্চাবি দিতে পারি কিন্তু ক্যামেরা চালাতে জানিনা। বৈমানিক তাকে ক্যামেরা চালানোর কৌশল শিখিয়ে দিলেন। বাঙ্গালি যুবকটা আত্মবিশ্বাসের সাথে চমৎকার ছবি তুলল। তখন এনালগ ক্যামেরায় সাদাকালো ছবি তোলা ক্রিটিক্যাল ছিল। এই প্রথম ক্যামেরা হাতে লুৎফর রহমান। তিনি জন্ম গ্রহন করেন ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় ১৯২৬ সালে। তার পিতা স্বপরিবারে রাজশাহীতে চলে আসেন। তার শৈশব—কৈশোর ও তারুণ্যে সোনালি দিনগুলো কেটেছে রাজশাহীর মহানগরীর কেন্দ্রস্থল বড়কাঠি এলাকায়। যৌবনেই ছবি তোলা তার একটা শখের বিষয়ে দাড়িয়েছিল। পরে পেশাদায়িত্ব হয়ে যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তিনি ফাটোগ্রাফীক নিজের ধ্যান ও জ্ঞানের সর্বোচ্চ স্থানে ধারণ করে কিনে ফেলেন ১২০ আগফা বক্স ক্যামেরা। তখন রাজশাহী শহরে অবস্থান করেন এবং একই সাথে স্টুডিও ফটোগ্রাফী ও প্রেসফটো কাভারেজের কাজ করে প্রশংসিত হন। অসহায় গরীব ছাত্রদের কাছ থেকে তিনি ছবির মিনিময়ে কোন পয়সা নিতেন না। রাজশাহী ও উত্তর বঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বড় কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক সভা হলেই ডাক পড়তো লুৎফর রহমানের। ষাটের দশকের প্রথমার্ধেই তিনি রাজশাহীর বিশিষ্ট নাগরিকদের সান্নিধ্যে আসেন। বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নানান ছবিগুলো সংগ্রহ করেন। তারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন। প্রতিষ্ঠাকালিন অনেক দুর্লভ সব ছবির কারিগর ছিলেন এই প্রথিতযশা আলোকচিত্র শিল্পি।
দীর্ঘ ৪৫ বছরের কর্মময় জীবনে প্রয়াত লুৎফর রহমান ১৯৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনী প্রচারনা, ৭০’র নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণসহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অসংখ্য দুর্লভ ছবি তুলেছেন। স্বাধীনতার পরবর্তী দেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রিয় প্রশাসনের গুরুত্বপুর্ণ অনুষ্ঠানিকতা ও ঘরোয়া মূহুর্তের বহু মূল্যবান ছবি তার ক্যামেরায় ধারণ করেছেন। যা কালের সাক্ষী; ইতিহাসের দৃশ্যপট হিসেবে প্রজন্ম ও প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রবর্তিত ১০ টাকার নোটে ব্যবহৃত বঙ্গবন্ধুর ছবিটিও তারই তোলা। এজন্য তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন। তিনি রেডিও পাকিস্তান এর মূখপত্র এলান ম্যাগাজিনে কাজ করতেন। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ বেতারের বেতার বাংলায় তার তোলা অনেক ছবি ছাপা হয়েছে। ছবি তুলেছেনঃ মাওলান ভাষানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, জেনারেল ওসমানী, আবুল মনসুর আহমদ, জিয়াউর রহমান, বেগম খালেদা জিয়া, কাজী নজরুল ইসলাম, শহিদুল্লাহ কায়দার, মেহেদী হাসান, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শেখ হাসিনা, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস, শাহ আব্দুল করীম, আব্দুল আলীম, আব্দুল জব্বার খান, কবি শামসুর রাহমান, গৌরী প্রসন্ন মজুমদার, খান আতাউর রহমান, সুমিতা দেবী, রহমান, রওশন জামিল এহতেশাম, গওহর জামিল, হাসান ইমাম, আনোয়ার হোসেন, ফেরদৌসী রহমান, শবনম, শাবানা, সুচন্দা, কবরী, ববিতা, আজিম, কমল দাসগুপ্ত। মহাখালীতে তার প্রতিষ্ঠিত ‘প্রতিচ্ছবি’ ফটো স্টুডিওটি যেন দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য পূরণ করা আর্কাইভ। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রী, একপুত্র তিন কন্যার জনক ছিলেন। তার সহধর্মিনী ও দু’কন্যা জীবিত, দু’কন্যা বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় প্রবাসী। তার পুত্র মোস্তাফিজুর রহমান মিন্টু দেশের প্রতিষ্ঠিত আলোকচিত্রী। লুৎফর রহমান ৭৪—এ যুক্তরাষ্ট্রে ফটোগ্রাফী কম্পিটিশনে ১ম পুরস্কার পান। ফটোগ্রাফীতে অবদান রাখার জন্য বিভিন্ন সময়ে ১২টি সার্টিফিকেট ও পদক লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য তিনি ভারত সরকারের কাছ থেকে ২টি সার্টিফিকেট লাভ করেন। প্রখ্যাত এ ফটোগ্রাফার ২০০৬ সালের ১১ অক্টোবর ইন্তেকাল করেন ।
দিবসটি উপলক্ষে মরহুমের নিজ বাস ভবনে এক দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।