মামলায় আসামিরা হলো চুনারুঘাট থানার সাদেকপুর গ্রামের নিহত আয়েশা আক্তারের স্বামী রাসেল মিয়া, রাসেল মিয়ার মা তাহেরা খাতুন, ভাই কাউছার মিয়া, বোন রুজি আক্তার ও হুছনা আক্তার। মামলায় পাঁচ আসামির সবাইকে দোষী সাব্যস্ত করে গত ২৬ অক্টোবর মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয় হবিগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ আদালতের বিচারক জাহিদুল হক। আসামি কাউছার মিয়া পলাতক। অন্য আসামিরা রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষণার দিন মা হুছনা আক্তারের সাথেই আদালতে এসেছিল ১০ মাসের শিশু মাহিদা। রায় ঘোষণার পর মায়ের সাথে মাহিদার জায়গা হয় হবিগঞ্জ কারাগারের ফাঁসির সেলে। হত্যাকাণ্ডের সময় হুছনা কলেজে লেখাপড়া করত। প্রায় দুই বছর আগে একই গ্রামের মিজানুর রহমানের সাথে তার বিয়ে হয়।
জেল কোডের ৭৩৫ বিধিতে সেলের কথা বলা হলেও এর আয়তন কি তার উল্লেখ নেই। তবে জানা গেছে, বিভিন্ন কারাগারে ৬ ফুট বাই ৬ ফুট থেকে ১০ ফুট বাই ১০ ফুট আয়তনের সেল রয়েছে। হবিগঞ্জ কারাগারে মহিলা বন্দীদের জন্য দু’টি সেল রয়েছে। হবিগঞ্জ কারাগারে ফাঁসির সেলের আয়তন প্রায় ১০ ফুট বাই ১০ ফুট। দু’টি সেলের একটিতে রয়েছেন মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ষাটোর্ধ্ব তাহেরা খাতুন, তার মেয়ে রুজি আক্তার, হুছনা আক্তার ও হুছনা আক্তারের ১০ মাসের কন্যা মাহিদা আক্তার। তাদের সেলের উত্তর দিকে একটি জানালা, আয়তন প্রায় ৩ ফুট বাই ৩ ফুট। তাও একাধিক টিন দিয়ে শক্ত করে সাটানো, বন্ধ করে দেয়া। কক্ষের দক্ষিণ দিকে অন্তত ১২ মিলিমিটার পুরুত্বের ১৪ শিকের (রডের) গেট। সেলে কোনো দরজা নেই। কক্ষ ঘেঁষে ছোট আয়তনের একটি বাথরুম। বাথরুমের সামনে প্রায় ৪ ফুট উচ্চতার দেয়াল। বাথরুমের সামনে একটি ভাঙা দরজা। দরজাটা লাগানো যায় না। লোহার শিকের বাইরে থেকে বড় একটি তালা ঝুলানো। দিনে সূর্যের আলো, জেল কোডের ৯৮৪ বিধি মোতাবেক রাতে থাকে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বৈদ্যুতিক আলো। বৈদ্যুতিক বাতি নেভানোর কোনো বিধান নেই। ফাঁসির সেলে বন্দীদের ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করে থাকেন কারারক্ষীরা।
হবিগঞ্জ কারাগারের ওই সেলে সরাসরি পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। ছোট বালতিতে করে পানি পাওয়া যায়, তাও সবসময় নয়, ওই পানিতেই চলতে হয় তাদের। একজন সশ্রম কারাবন্দী যে হারে খাবার পান ফাঁসির সেলে বন্দীদের একই নিয়মে খাবার দেয়া হয়ে থাকে।
২৪ ঘণ্টার মধ্যে দিনে দেড় ঘণ্টার জন্য ১০ ফুট বাই ১০ ফুট আয়তনের কক্ষের তালা খুলে দেয়া হয়। তালা খুলে দেয়ার পর দেড় ঘণ্টার জন্য ওই কক্ষের শিশু মাহিদাসহ চার বাসিন্দার পরবর্তী গন্তব্য কক্ষের সামনের ৬ ফুট বাই ১০ ফুট আয়তনের বারান্দা। এ ব্যাপারে হবিগঞ্জ কারাগারের জেলার মাসুদ হাসান জানান, সাধারণ বন্দীদের মতোই সেলে বন্দীরা খাবার পেয়ে থাকেন। মায়ের সাথে সেলে থাকা শিশু মাহিদার জন্য দুধ ও ডিমের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চঞ্চল ও পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখা শিশু মাহিদা দিন দিন নুইয়ে যাচ্ছে। মাহিদার স্বজনরা জানিয়েছেন, প্রায় একমাসের ব্যবধানে মাহিদার ওজন কমেছে প্রায় ২ কেজি। সদ্য দাঁত উঠতে শুরু করা মাহিদাকে কোনো ফলমূল পিষিয়ে খাওয়ানোর কোনো সুযোগ নেই, সুযোগ নেই কাঁদলেই তার মুখে তুলে দেয়ার মতো অন্য খাবার। একটি নির্জন কক্ষে দিনে রাতে সমানতালে আক্রমণ করে থাকে মশা। মশারি বা কয়েল ব্যবহারেরও কোনো অনুমতি নেই কারাগারে।
একজন গৃহবধূ জানিয়েছেন-১০/১১ মাস বয়সী একটি শিশুর প্রতিদিন কমপক্ষে ২০/২৫টি ছোট কাঁথার প্রয়োজন হয়। নিয়মিত তা ধৌত করতে হয়, শুকাতে হয়। কারাগারে এসব সুবিধা দেয়া সম্ভব নয়।
এ ব্যাপারে হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক ডাক্তার সাইফুর রহমান সোহাগ জানান, মা বাবার সহাবস্থান একটি শিশুকে পরিপূর্ণ করতে পারে। শিশুরা দেখে বেশি শিখে, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ শিশুকে বেশি প্রভাবিত করে। একজন শিশুর শুরু থেকেই কনফিডেন্স তৈরি হয়। ফাঁসির সেলের যে বর্ণনা জানা গেছে, তাতে কোনোভাবেই একজন শিশু পরিপূর্ণভাবে বেড়ে উঠবে না, তার মানসিক বিকাশ নষ্ট হয়ে যাবে, কনফিডেন্স নষ্ট হয়ে যাবে, দীর্ঘদিন ফাঁসির সেলে থাকার কারণে যে কোনো শিশু মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে।