প্রায় ১১ বছর পর বগুড়া বিএনপির নতুন কমিটি গঠিত হতে যাচ্ছে আগামী ২ নভেম্বর। এজন্য ৯ সদস্যের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়েছে ইতোমধ্যে।
কমিটির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম জানান, জেলা কমিটি ১৭২ সদস্যের হলেও নির্বাচন হবে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং সাংগঠনিক সম্পাদকের তিন পদে। ১৭ অক্টোবর থেকে মনোনয়নপত্র বিক্রি শুরু হবে। যাচাই-বাছাই শেষে আগামী ১৯ অক্টোবর চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হবে।
দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা বলছেন, ১৯৯৯ সালে বগুড়া বিএনপিতে প্রথম গোপন ব্যালটে নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয়েছিল। তখন বগুড়ার অনুকরণে দেশের অন্য জেলাগুলোতেও গোপন ব্যালটে বিএনপির নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয়। তারেক রহমানের নিজ জেলা থেকে শুরু করার কারণে নেতৃত্ব নির্বাচনের ওই পদ্ধতিটি সারা দেশে বগুড়া মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। তবে পরবর্তীতে ওই প্রক্রিয়াটি বিএনপি ধরে রাখতে পারেনি। এমনকি ২০১১ সালের ৭ এপ্রিল বগুড়া জেলা বিএনপির সর্বশেষ কমিটি গঠিত হয়েছিল কোনো সম্মেলন ছাড়াই। তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকা থেকে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং সাংগঠনিক সম্পদক পদে মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেছিলেন। এরপর ২০১২ সালের ২৩ অক্টোবর ১৭২ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটি গঠন করা হয়।
অবশ্য ওই কমিটির মেয়াদ ২০১৫ সালে উত্তীর্ণ হয়ে গেলেও নতুন করে সম্মেলনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এতে বগুড়া বিএনপিতে অভ্যন্তরীণ বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। পরিস্থিতি সামাল দিতে তৎকালীন জেলা বিএনপির সভাপতি সাইফুল ইসলাম ২০১৯ সালের ২৯ এপ্রিল তার নিজ অনুসারীদের নিয়ে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেন। তবে একই দিন বগুড়া জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট একেএম মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে পাল্টা আরেকটি আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়। এভাবে দলের অভ্যন্তরে দুটি পক্ষ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাওয়ায় লন্ডনে নির্বাসিত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ক্ষুব্ধ হন। পরে তার নির্দেশে ২০১৯ সালের ১৫ মে বগুড়া সদর আসনের সংসদ সদস্য গোলাম মোহাম্মদ সিরাজকে প্রধান করে ৩১ সদস্যবিশিষ্ট জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। ওই কমিটি আড়াই বছরেও সম্মেলন আয়োজন করতে না পারায় ২০২১ সালের ১৩ নভেম্বর আহ্বায়ক পদে পরিবর্তন আনা হয়। সংসদ সদস্য গোলাম মোহাম্মদ সিরাজের পরিবর্তে জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি বগুড়া পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম বাদশাকে আহ্বায়ক মনোনীত করা হয়।
এবার সম্মেলনের তারিখ ঘোষণার পরপরই সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচন করতে আগ্রহী প্রার্থীরা নিজে এবং তাদের অনুসারীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার-প্রচারণা শুরু করেছেন।
নেতাকর্মীরা জানান, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক রেজাউল করিম বাদশা, যুগ্ম আহ্বায়ক ফজলুল বারী তালুকদার বেলাল ও সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলাম সভাপতি পদে প্রার্থী হচ্ছেন। অন্যদিকে জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন চান, সহসভাপতি আলী আজগর তালুকদার হেনা, জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি এমআর ইসলাম স্বাধীন ও বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি খায়রুল বাশার সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আগ্রহী।
সাংগঠনিক সম্পাদকের দুটি পদে প্রার্থিতার জন্য এখন পর্যন্ত যাদের নাম শোনা যাচ্ছে, তারা—হলেন বগুড়া শহর বিএনপির সভাপতি হামিদুল হক চৌধুরী হিরু, জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি শহিদুন্নবী সালাম, শেখ তাহা উদ্দিন নাহিন, মাইদুল ইসলাম গফুর ও আব্দুল আজিজ হিরা।
বগুড়া জেলা বিএনপিতে সভাপতি পদে সাবেক দুই সভাপতি রেজাউল করিম বাদশা এবং সাইফুল ইসলামের মধ্যেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পরে বলে নেতাকর্মীদের ধারণা।
দুজনের মধ্যে রেজাউল করিম বাদশা আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর থেকেই তৃণমূলের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় জড়িত রয়েছেন। তবে আহ্বায়ক কমিটি গঠন নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে সাইফুল ইসলাম প্রায় তিন বছর দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকার পর চলতি বছরের মে মাসে জেলা বিএনপির রাজনীতিতে ফের সক্রিয় হন।
নেতারা জানান, বর্তমানে জেলা বিএনপিতে আহ্বায়ক পদে অধিষ্ঠিত রেজাউল করিম বাদশা সভাপতির পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ইচ্ছা প্রকাশ করায় তৃণমূলের নেতৃবৃন্দের একটি অংশ তার বিরুদ্ধে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা অমান্য করার অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। তারা বলছেন, সাড়ে তিন বছর আগে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের প্রাক্কালে তারেক রহমান বলেছিলেন, জেলা ও উপজেলা কমিটিতে যারা আহ্বায়ক ও যুগ্ম আহ্বায়কের পদ গ্রহণ করবেন, তারা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হতে পারবেন না।
ওই নির্দেশনার কারণেই ইতঃপূর্বে বগুড়ায় বিএনপির উপজেলা এবং পৌর কমিটিগুলো পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক পদ পেতে আগ্রহী কেউ আহ্বায়ক কিংবা যুগ্ম আহ্বায়ক হননি। কিন্তু এখন যদি খোদ জেলা কমিটির আহ্বায়ক রেজাউল করিম বাদশা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সেই নির্দেশনা অমান্য করে জেলা বিএনপির সভাপতি পদে প্রার্থী হন, তাহলে দলের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে।
দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতা জানান, বগুড়া জেলা বিএনপির আহ্বায়ক রেজাউল করিম বাদশার সভাপতি পদে প্রার্থিতার বিষয়টি তারা তারেক রহমানের কাছে উত্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ ছাড়া বগুড়া পৌরসভায় মেয়রের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার পরও রেজাউল করিম বাদশার দলের সভাপতি হতে যাওয়া উচিত কী না, সে বিষয়টিও তারা তুলবেন। তাদের অভিযোগ—একই ব্যক্তি একাধিক পদ গ্রহণ করলে শুধু নেতৃত্বের বিকাশই বাধাগ্রস্ত হবে না, আগামীতে সরকারবিরোধী আন্দোলন বেগবান করাও কঠিন হয়ে পড়বে।
একাধিক নেতা জানান, তারেক রহমান দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দের অভিযোগ আমলে নিলে রেজাউল করিম বাদশার সভাপতি পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে ওই পদে সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলামের নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক পদে আলী আজগর তালুকদার হেনার সঙ্গে জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি এমআর ইসলাম স্বাধীনের মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।
বগুড়া জেলা বিএনপির আহ্বায়কের পদে থেকেও সভাপতি পদে রেজাউল করিম বাদশার প্রার্থিতার বিষয়ে জানতে চাইলে দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম বলেন, যারা আহ্বায়ক ও যুগ্ম আহ্বায়ক হবেন, তারা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হতে পারবেন না বলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের একটি মৌখিক নির্দেশনা ছিল।
তবে এ ব্যাপারে লিখিত কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। আর প্রার্থিতার বিষয়ে ইতঃপূর্বে রেজাউল করিম বাদশা জানিয়েছিলেন, তিনি তো প্রথমে আহ্বায়ক ছিলেন না। পরে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে কোনো অসুবিধা নেই।