বঙ্গ নিউজ বিডি প্রতিনিধি : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যে কজন মহাপ্রাণ দেশপ্রেমিক বীরপুরুষ অবিস্মরণীয়, তাঁদের মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, বঙ্গবীর জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী। তিনি ছিলেন এক অনন্য প্রতিভাধর সামরিক ব্যক্তিত্ব, যার নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সামরিক কাঠামো। তাঁর সুদূরপ্রসারী কৌশল, বীরত্ব ও দৃঢ়তার কারণেই মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরও তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। আজ ১৬ ফেব্রুয়ারি, এই মহান বীরের ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা স্মরণ করি তাঁকে এবং সেই প্রশ্নগুলো উত্থাপন করি, যা আজও বাঙালি জাতির বিবেককে নাড়া দেয়।
কেন তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ছিলেন না?
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, বাংলাদেশের জন্য এক গৌরবময় দিন। এই দিন পাক হানাদার বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না।
সরকারি ভাষ্যমতে, তাঁর হেলিকপ্টার সময়মতো ঢাকায় পৌঁছাতে পারেনি। তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, তাঁকে ইচ্ছাকৃতভাবেই অনুষ্ঠানে আনা হয়নি। কারণ, তৎকালীন ভারতীয় সামরিক নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক মহল চেয়েছিল আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব পাক ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। ভারত চেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদানকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে। এছাড়া, স্বাধীন বাংলাদেশে ওসমানীর সামরিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা কমিয়ে আনার একটি সুপরিকল্পিত কৌশলও থাকতে পারে। তাই তাঁকে ঐতিহাসিক মুহূর্ত থেকে দূরে রাখা হয়।
কেন তাঁকে ফিল্ড মার্শাল উপাধি প্রদান করা হয়নি?
জেনারেল ওসমানী মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক নেতা ছিলেন। যুদ্ধ জয়ের পর যুক্তিসঙ্গতভাবেই তাঁর জন্য “ফিল্ড মার্শাল” উপাধি প্রাপ্য ছিল। কিন্তু তাঁকে এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
এর পেছনে কয়েকটি কারণ হতে পারে:
1. রাজনৈতিক প্রভাব ও ভারতীয় কূটনীতি: স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ভারতপন্থী রাজনীতির প্রভাব ছিল প্রবল। ভারতীয় নেতৃত্ব চায়নি যে ওসমানীর মতো স্বাধীনচেতা ও অভিজ্ঞ সামরিক নেতা অতিরিক্ত ক্ষমতা পান।
2. একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা: ১৯৭৫ সালে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশে একদলীয় শাসন কায়েম করা হয়। ওসমানী গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি ছিলেন এবং একদলীয় শাসনের বিরোধিতা করেছিলেন। ফলে, তাঁকে অবমূল্যায়ন করার রাজনৈতিক প্রয়াস ছিল।
3. সামরিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছা: ওসমানী যদি ফিল্ড মার্শাল হতেন, তবে সেনাবাহিনীতে তাঁর প্রভাব ব্যাপকভাবে বাড়ত। এটা তৎকালীন সরকার চাইনি।
কেন রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁর জন্ম ও মৃত্যু দিবস পালন করা হয় না?
একটি স্বাধীন জাতির জন্য তাঁর সর্বাধিনায়ককে সম্মান জানানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ, জেনারেল ওসমানীর জন্ম ও মৃত্যু দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয় না। এর প্রধান কারণ:
1. রাজনৈতিক অবহেলা: তিনি কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের অনুগত ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন নীতি ও আদর্শের অনুসারী। ফলে, রাজনৈতিক মহল তাঁকে নিয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি।
2. তাঁর সত্যনিষ্ঠ অবস্থান: তিনি কোনো সময় আপস করেননি। যখন দেখলেন দেশ একদলীয় শাসনের দিকে যাচ্ছে, তিনি সংসদ থেকে পদত্যাগ করলেন। এই নৈতিক দৃঢ়তা তাঁকে কিছু মহলের অপছন্দনীয় করে তোলে।
3. ইতিহাস বিকৃতি: স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে রাজনৈতিকভাবে বিকৃত করা হয়েছে। ফলে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ভূমিকা আড়ালে চলে গেছে।
কেন পাঠ্যপুস্তকে তাঁর জীবন-কাহিনী তুলে ধরা হচ্ছে না?
আজকের প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু পাঠ্যপুস্তকে ওসমানীর জীবন ও কর্ম নিয়ে বিশেষ কিছু নেই। এর কারণ:
1. ইতিহাস বিকৃতি: দীর্ঘদিন ধরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিভিন্ন সরকার তাদের স্বার্থে পরিবর্তন করেছে। ফলে, প্রকৃত ইতিহাস থেকে অনেক গৌরবময় অধ্যায় বাদ গেছে।
2. রাজনৈতিক সুবিধাবাদ: ওসমানী কোনো নির্দিষ্ট দলের ছিলেন না। ফলে, রাজনৈতিক দলগুলো তাঁকে নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি।
3. সেনাবাহিনীর ইতিহাস অবহেলিত: বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সামরিক ইতিহাস নিয়ে গবেষণা ও চর্চার তেমন সুযোগ নেই। ফলে, সেনানায়ক ওসমানীকে যথাযথভাবে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
উপসংহার
বঙ্গবীর এম. এ. জি. ওসমানী ছিলেন এক কিংবদন্তি নেতা, যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযথ মর্যাদা পাননি। তাঁর অনুপস্থিতিতে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান, ফিল্ড মার্শাল উপাধি না পাওয়া, জন্ম ও মৃত্যু দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন না করা এবং পাঠ্যপুস্তকে তাঁর জীবন-কাহিনী অন্তর্ভুক্ত না করা আমাদের জাতির জন্য লজ্জার বিষয়।
এখন সময় এসেছে তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন করার। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁর জন্ম ও মৃত্যু দিবস পালন, পাঠ্যপুস্তকে তাঁর অবদান অন্তর্ভুক্ত করা এবং তাঁকে সর্বোচ্চ সামরিক স্বীকৃতি প্রদান করা উচিত। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। বীরদের যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে, নইলে জাতি ভবিষ্যতে ইতিহাসের বিচার এড়াতে পারবে না।
বঙ্গবীর জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানী চিরঞ্জীব হোক! মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে দোয়া করি। জান্নাতুল ফেরদৌসের মধ্যে তাঁকে সুমহান মর্যাদা দান করুন মহান রাব্বুল আলামীন এই প্রার্থনা করি।
লেখক: মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন