ডেস্ক: বিটকয়েনে লেনদেনকে যারা সমর্থন করেন, তাদের দাবি ভবিষ্যতের মুদ্রা হবে বিটকয়েন। এই ডিজিটাল মুদ্রাতেই ভবিষ্যতে মানুষ অনলাইনে আর্থিক লেনদেন করবে। এর ফলে মানুষকে আর বড় বড় ব্যাংকের ওপর নির্ভর করতে হবে না। এই মুদ্রায় লেনদেনের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট আইনকানুন না থাকায় দায়বদ্ধতার ব্যাপারে উদ্বেগ আছে। পাশাপাশি আছে পরিবেশের ওপর এর প্রভাব নিয়ে বড় ধরনের আশঙ্কা।
তবে এসব উদ্বেগ আশঙ্কা উপেক্ষা করেই বিশ্বজুড়ে বাড়ছে বিটকয়েনের লেনদেন। আসুন বিটকয়েন সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক কিছু তথ্য।
বিটকয়েন হলো একটি ভার্চুয়াল মুদ্রা, যা কম্পিউটারের মাধ্যমে আদানপ্রদান করা হয়। একে ক্রিপ্টোকারেন্সিও বলা হয়ে থাকে। বিট কয়েনের সাংকেতিক প্রতীক হল BTC, এবং এর ক্ষুদ্র একক হল সাতোশি। ওপেন সোর্স ক্রিপ্টোগ্রাফিক প্রোটকলের মাধ্যমে এই সাংকেতিক মুদ্রার লেনদেন হয়ে থাকে। যেমন আমাদের দেশের জন্য মূদ্রা টাকা, USA এর জন্য ডলার! তবে এর কোনো Physical properties নেই! মানে একে ধরা বা ছোয়া যায় না! এটি শুধু ইন্টারনেটের মাধ্যমেই ব্যবহার যোগ্য৷
বিটকয়েন লেনদেনের জন্য মধ্যস্থতাকারী কোন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, নিয়ন্ত্রনকারী প্রতিষ্ঠান বা নিকাশ ঘরের প্রয়োজন হয় না। যারা আদান-প্রদান করে তাদের হাতেই থাকে এর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। তারা কাউকে কোনও কমিশন না দিয়েই আদান-প্রদান করতে পারে এই ভার্চুয়াল কারেন্সি। এটি আদান-প্রদানে কোনও কাগুজে বা ধাতব মুদ্রারও প্রয়োজন হয় না। তবে চাহিদা থাকায় আবার যে কেউ চাইলে এটাকে ডলার বা অন্য কোনও কারেন্সিতে রূপান্তর করতে পারে।
বিটকয়েন সরাসরি বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি অর্থাৎ দুই পক্ষের মধ্যে লেনদেনে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। যার কারণে প্রচলিত অর্থব্যবস্থায় বিটকয়েন বৈধতা পায়নি। তাই বলে থেমে নেই বিটকয়েন বা ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেন। পণ্য বা সেবা ক্রয়ে এখন আমেরিকাসহ ইউরোপের অনেক দেশে বিটকয়েন বিকল্প মাধ্যম। এমনকি মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠানও এখন বিটকয়েন নিচ্ছে।
প্রযুক্তি যতো এগোচ্ছে ততোই সম্ভাবনাময় হয়ে উঠছে বিটকয়েন। এরই মধ্যে পেপাল ক্রিপ্টোকারেন্সি বাজারে প্রবেশ করেছে। যার অর্থ হলো—পেপাল ব্যবহারকারীরা বিটকয়েনসহ অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সি ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবেন। পেপালের দেওয়া সুবিধার কারণে বিটকয়েনের মাধ্যমে ২ কোটি ৬০ লাখ বিক্রেতার কাছ থেকে বিভিন্ন পণ্য কেনা যাবে।
বিটকয়েনের জনপ্রিয়তায় প্রতিদিনই বাড়ছে এর অর্থমূল্য। চলতি অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে প্রতি বিটকয়েনের মূল্য ৬৬ হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ডিজিটাল মুদ্রাসংক্রান্ত খবর ও বিশ্লেষণ মাধ্যম কয়েনডেস্কের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বিটকয়েনের মূল্য এখন (অক্টোবর ২০২১) ৬৬ হাজার ৯৬ ডলার।
২০০৮ সালে সাতোশি নাকামোতো ছদ্মনামে কোন এক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এই মুদ্রাব্যবস্থার প্রচলন করেন। প্রবর্তনের পর থেকেই বিটকয়েনের লেনদেন পিয়ার টু পিয়ার বা গ্রাহক থেকে গ্রাহকের কম্পিউটারে বা মোবাইলের মাধ্যমে হয়ে আসছে। বিটকয়েনের প্রতিটি আদান-প্রদান পাবলিক লিস্টে রেকর্ডেড থাকে যেটিকে বলা হয় ব্লকচেইন। এই ব্লকচেইনের মাধ্যমে বিটকয়েনের ওপর নজরদারি রাখা যায়। বিশেষ করে মালিক না হয়ে কেউ যেন বিটকয়েন খরচ করতে না পারে এবং বিটকয়েনকে যেন নকল করা না যায় সেজন্যই এই ব্লকচেইন। আর এতেই এটি তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
শক্তিশালী কম্পিউটারের সাহায্যে বিভিন্ন জটিল কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে বিটকয়েন তৈরি করা হয়। এটি তৈরির পদ্ধতিকে বলা হয় মাইনিং। বিটকয়েন বা ক্রিপ্টোকারেন্সি সংখ্যার দিক থেকে সীমিত। যার কারণে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার পর কোন ক্রিপ্টোকারেন্সি মাইনিং বা উৎপাদন করা সম্ভব নয়। বিটকয়েন সর্বোচ্চ ২১মিলিয়ন ইউনিট পর্যন্ত মাইনিং করা যাবে। এরপর আর কোন বিটকয়েন মাইনিং করা সম্ভব হবে না। এখন অব্দি ১৯ মিলিয়ন বিটকয়েন মাইন করা হয়ে গিয়েছে। আর তিন মিলিয়ন মত বিটকয়েন মাইনিং করা বাকি আছে। এবং বিটকয়েনের অ্যালগরিদম অনুযায়ী শেষ বিটকয়েন মাইন করতে ২১৪০ সাল অব্দি সময় লেগে যেতে পারে। বিটকয়েন তৈরির প্রক্রিয়া দিন দিন আরও জটিল হচ্ছে যেন বিটকয়েন তৈরির পরিমাণ কমানো যায়। বর্তমানে বিটকয়েন তৈরির কাজ শুরু করলে একটি কয়েনের মালিক হতে কয়েক বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।
বিটকয়েনের জনপ্রিয়তার বড় একটি কারণ হলো—বিটকয়েনে বিনিয়োগ করলে কয়েকগুণ লাভ হবে, এমন ধারণা। বিটকয়েন আলোচনায় উঠেও এসেছে এ কারণেই। গত এক মাসেই ভার্চুয়াল মুদ্রাটির দাম হু হু করে বেড়েছে। ফলে অনেকেই এই বিটকয়েন কেনার দিকে ঝুঁকছেন।
তিনটি উপায়ে বিটকয়েনের মালিক হওয়া যায়। নগদ অর্থের বিনিময়ে বিটকয়েন কেনা যায়। আপনি বিটকয়েনের পরিবর্তে কোনও কিছু বিক্রি করতে পারেন। আবার চাইলে কম্পিউটারের প্রসেসিং ক্ষমতা ব্যবহার করে বিটকয়েনের মালিক হওয়া যায়।
বিটকয়েনের ওপর সরকার বা ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেই। এ কারণেও অনেকের কাছে এটি পছন্দের বিনিময় মাধ্যম। নিজের পরিচয় গোপন রেখে এটি ব্যবহার করা যায়। আদান-প্রদানের সবকিছু সংরক্ষিত থাকলেও কোনটি কার বিটকয়েন, সে সম্পর্কে কোনও তথ্য থাকে না। তবে বিবিসি জানিয়েছে, ক্রিপ্টোকারেন্সি বর্তমানে একটি উপযুক্ত পেমেন্ট মেথড হিসেবে গড়ে উঠেছে। পেপাল জানায়, তারা আশা করছে— গ্রাহকদের মাঝে ক্রিপ্টোকারেন্সির ধারণাকে আরও পরিষ্কার করে তুলতে পারবে।
ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু পেপাল ব্যবহারকারী বিটকয়েনের সাহায্যে বিভিন্ন পণ্য ও সেবা ক্রয় করতে পারছেন। জানা গেছে, আগামী বছরের শুরু থেকে সব গ্রাহককেই এ সুবিধা দেবে পেপাল কর্তৃপক্ষ।
বিটকয়েন বাংলাদেশে স্বীকৃত নয়, এক কথায় নিষিদ্ধ। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক দেশে এই মুদ্রার ব্যবহার বৈধ করেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে এই মুদ্রার লেনদেনে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ সম্পর্কিত আইনের লঙ্ঘন হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের জনগণকে বিটকয়েনের বিষয়ে সতর্ক করে বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে। তাতে বলা হয়, বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে দেশে বিটকয়েনের লেনদেন হচ্ছে, যা কোনও নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত নয়। এসব ভার্চুয়াল মুদ্রার ব্যবহার বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৪৭, সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯ এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২-এর দ্বারা সমর্থিত হয় না। ফলে মানুষের আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
বিটকয়েনের দেখাদেখি অবশ্য আন্তর্জাতিক বাজারে এখন অনলাইনভিত্তিক আরও কিছু ভার্চুয়াল মুদ্রাও এসেছে। এর মধ্যে ইথারিয়াম, রিপ্পেল ও লিটকয়েন বিভিন্ন বিনিময় প্ল্যাটফর্মে লেনদেন হচ্ছে। এসব ভার্চুয়াল মুদ্রা কোনও দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ইস্যু করা বৈধ মুদ্রা নয়। ফলে এর বিপরীতে কোনও আর্থিক দাবির স্বীকৃতিও নেই।