বঙ্গনিউজবিডি ডেস্ক : কখনো কি এমন নিঃসঙ্গতা মানুষের ঠিকানা হতে পারে, মানুষ কি আদতে এমন নির্জনতা চায় মনে মনে, আসলে মানুষ নিঃসঙ্গতা ছাড়া আর কীই–বা পায় জীবনে? প্রত্যেকটি মানুষ সে তার নিজের মধ্যে ভীষণ একলা। আর এসব একলা মানুষেরও কোনো ঠিকানা আছে পৃথিবীতে, ভাবতেই অবাক লাগে।
একজন পিতা তার জীবনের সবকিছু বিলিয়ে দেন সন্তানের জন্য, অথচ সেই সন্তানেরা মা–বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যান, আর খোঁজ-খবর নেন না। ভাবতেই বড় অবাক লাগে।
তেমনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ (দক্ষিণ শহর) মহানন্দা প্রবীণ নিবাসের (বৃদ্ধাশ্রম) দুই বৃদ্ধ বাবা তার জীবনের নানান কথা বলেছেন, আসুন শুনি তাদের জীবনের না বলা কথা….
আব্দুর রশিদ। বয়স প্রায় ৮০ বছর। জন্মস্থান সিরাজগঞ্জ হলেও চাকরির সুবাদে চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিয়ে করে স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছিলেন। থাকতেন পৌর এলাকার নামোশংকরবাটি এলাকায়। বিবাহিত জীবনে চার ছেলে ও এক মেয়ের জনক তিনি। এর মধ্যে দুই ছেলে সরকারি চাকরিজীবী, দুই ছেলে ব্যবসায়ী। আর মেয়েকে নিয়ে স্ত্রী থাকেন নিজ বাড়িতে। আব্দুর রশিদ নিজেও ছিলেন সরকারি কর্মচারী। সেই টাকা দিয়ে একটি বাড়িও করেছেন নামোশংকরবাটি এলাকায়। তবে শেষ বয়সে এসে সেই বাড়িতে থাকার সোভাগ্য তার হয়নি। স্ত্রী ও ছেলেদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে এখন তিনি বৃদ্ধাশ্রমে।
আব্দুর রশিদ বলেন, চাকরির সুবাদে সিরাজগঞ্জ থেকে এসে বিয়ে করেছিলাম চাঁপাইনবাবগঞ্জে। আমি এখানে কৃষি বিভাগে ফার্ম সুপারভাইজার হিসেবে চাকরি করতাম। ২০ বছর আগেই আমার চাকরির বয়স শেষ হয়। তবে এখনও চাকরির ভাতা পাই। সে টাকা দিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে খরচ দিই।
তিনি বলেন, চাকরির যে টাকা জমিয়েছিলাম তা দিয়ে একটি বাড়িও করেছি। ছেলেরা নিজ নিজ বাড়ি করে বাইরে থাকে পরিবার নিয়ে। স্ত্রী আর ছেলেদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে এখন বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই নিয়েছি। আমার চার ছেলে। কেউ আমাকে তাদের কাছে রাখেনি।
তিনি আরও বলেন, আমার এক ছেলে আব্দুর রহমান শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত ও আরেক ছেলে মোস্তফা কামাল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে দপ্তরির দায়িত্ব পালন করছেন। টাকা পয়সার অভাব নেই তাদের। ওদের সুখের জন্য জীবনের অনেক কিছু ত্যাগ করেছি। তবুও তাদের মন পাইনি। আমি তাদের বলে দিয়েছি আমার মৃত্যুর পরও যেন তারা আমাকে দাফন করতে না আসে।
তবে আব্দুর রশিদের ছেলে আব্দুর রহমানের অভিযোগ, ‘আমার বাবা নিজের দোষেই বৃদ্ধাশ্রমে থাকছেন। আমরাতো নিজ নিজ বাড়ি করে বাইরে থাকি। কেউ তাকে জ্বালায় না। বরং তিনিই বাড়ির লোকজনকে জ্বালাতন করেন।’
ওই বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই হয়েছে শিবগঞ্জ উপজেলার নয়ালাভাঙ্গা ইউনিয়নের মো. কালু মণ্ডলের। তার কষ্টও কম নয়।
তিনি বলেন, আমার স্ত্রী দুই কাঠা জমি বিক্রি করে বিদেশে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু দালালের খপ্পরে পড়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ঘুরে আসতে হয়েছে। পরে ছেলের বিয়ে দিয়ে টাকা নিয়ে ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়েছেন। কিন্তু নতুন বউ এসেই সংসারে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। আমার দুই বিঘা জমি ছিল, আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে বলে সেটাও লিখে নিয়েছে। তখন থেকে আমাকে আর খেতে দেয় না।
তিনি বলেন, ‘একটিমাত্র ঘর ছিল সেটাও ভেঙে দিয়েছে আমার স্ত্রী ও ছেলের বউ মিলে। কতদিন মানুষের দ্বারে দ্বারে চেয়ে খাওয়া যায়? কত শীতের রাত কাটিয়েছি খোলা আকাশের নিচে। না খেয়ে থাকার যন্ত্রণা সইতে না পেরে এখানে ঠাঁই নিয়েছি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ (দক্ষিণ শহর) মহানন্দা প্রবীণ নিবাসের (বৃদ্ধাশ্রম) পরিচালক মো. মোস্তাফিজুল হক বলেন, আব্দুর রশিদ ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। এখনও তিনি সরকারি ভাতা পান। তিনি অনেক কষ্টে চার ছেলেকে লেখাপড়া করিয়েছেন। কিন্তু ছেলেদের সঙ্গে থাকার ভাগ্য তার হয়নি।
তিনি জানান, ২০১৬ সালে সমাজসেবার অনুমোদন নিয়ে জেলার ১৮ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির উদ্যোগে সাড়ে তিন বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলা হয় বৃদ্ধাশ্রমটি। বর্তমানে তাদের থাকার জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা ওয়ার্ড এবং আলাদা বিছানা।
তাদের কাপড় থেকে শুরু করে খাবার যাবতীয় প্রয়োজন সবকিছু বহন করা হয় এই বৃদ্ধাশ্রমে। তাদের রুটিন করে খাবার দেওয়া হয়। এই বৃদ্ধাশ্রমে গত ৫ বছরে প্রায় ৭৬ বৃদ্ধকে আশ্রয় দিয়েছি। এখানে বর্তমানে চারজন পুরুষ ও ৬ ছয়জন নারী রয়েছেন।