বঙ্গনিউজবিডি ডেস্ক : জাতীয় ফল কাঁঠাল পাকাতে এখন আর প্রকৃতির ওপর নির্ভর করছে না মধুপুর উপজেলার কৃষক ও কাঁঠাল ব্যবসায়ীরা। এক রকম জোর করেই পাকানো হচ্ছে মধুমাসের জাতীয় ফল কাঁঠাল।
কাঁঠাল ব্যবসায়ী ও কৃষকেরা এক ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক ওষুধ প্রয়োগ করে জোর করেই কাঁঠাল পাকানো হচ্ছে।
বেশি লাভের আশায় মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই কচি কাঁঠালে নির্বিচারে প্রয়োগ করছে বিষাক্ত রাইপেন ও ইথিফন জাতীয় বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ। আর এ সকল রাসায়নিক দ্রব্য বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নামে বাজারগুলোর প্রতিটি কীটনাশকের দোকানে সারি সারি সাজানো রয়েছে।
প্রতি মৌসুমেই টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার প্রায় ১০-১৫টি বাজারে প্রচুর পরিমাণ ওঠে মৌসুমী ফল কাঁঠাল। মধুপুরের গারো বাজার, কুড়ালিয়া বাজান, চাপড়িবাজার, নেদুর বাজার, মোটের বাজার, ইদিলপুর বাজার, জলছত্র পচিশ মাইল বাজারসহ অনেক বাজার থেকে প্রতি হাটবার এক শ’ থেকে দেড় শতাধিক ট্রাক কাঁঠাল রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যায়।
এছাড়াও মধুপুরের পাশের উপজেলা ঘাটাইলে উৎপাদন হয় প্রচুর কাঁঠাল। এবার মধুপুরে কাঁঠালের ফলন অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক কম। কাঁঠালের আকারও হয়েছে ছোট। প্রাকৃতিক আবহাওয়াগত ও অনাবৃষ্টির কারণে এবারের কাঁঠাল একটু দেরিতে নামতে শুরু করেছে।
চলতি মৌসুমে এসব এলাকায় শুরু হয়েছে কাঁঠালে রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়োগের প্রতিযোগিতা। স্থানীয় ভাষায় রাসানিক প্রয়োগের এ পদ্ধতিকে ‘শিক মারা’ বলে। প্রায় দেড় ফুট লম্বা লোহার শিক কাঁঠালের বোটা বরাবর ঢুকিয়ে দিয়ে ছিদ্রপথে সিরিঞ্জ দিয়ে বিষাক্ত কার্বাইড, ইথিফন ও রাইপেন জাতীয় পদার্থ প্রয়োগ করা হয়। পরে স্তূপাকারে সাজিয়ে পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে চাপা দিয়ে রাখলেই ২৪ ঘণ্টায় একটি কচি কাঁঠালও পেকে যায়। মেশিনে স্প্রে করেও রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগ করে থাকেন কেউ কেউ।
চলতি মৌসুমে মধুপুরের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে দেখা যায় অন্য বছরের তুলনায় কাঁঠালের ফলন কম হয়েছে। ধামাবাশুরী গ্রামের মাদরাসা শিক্ষক মোহাম্মদ মহির উদ্দিন বলেন, এবার অন্য বছরের তুলনায় কাঁঠালের ফলন অনেক কম হয়েছে।
চাপড়ী গ্রামের কাঁঠাল চাষী মো: আমিনুল ইসলাম আকন্দ বলেন, তার বাড়ির গাছগুলোতে গত বছরের তুলনায় এবার অনেক কম কাঁঠাল ধরেছে, কিন্তু দামও কমে গেছে। প্রচণ্ড তাপের কারণে কাঁঠালের আকারও বেশ ছোট।
গারোবাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মো: জামাল হোসেন বলেন, পাহাড়ি অঞ্চলে পুরাতন কাঁঠালগাছ কেটে দ্রুত বর্ধনশীল গাছ রোপন করেছে অনেকেই। এ কারণে আগের মতো বড় বড় কাঁঠাল গাছের বাগান নেই, ফলনও কম।
বেশি লাভের আশায় আগাম কাঁঠাল বাজারে আনতে শুরু করেছে অনেকেই। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক প্রয়োগ করে নষ্ট করা হচ্ছে কাঁঠালের প্রাকৃতিক স্বাদ। এ কারণে এখন সচেতন মানুষেরা অনেকেই কাঁঠাল খেতে চান না।
মুরাইদ গ্রামের কাঁঠাল ব্যবসায়ী চান মাহমুদ বলেন, আজ (০১ জুন) গারোবাজারে কাঁঠালের পরিমাণ অন্য বছরের তুলনায় অর্ধেক, দামও কম। এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসায় লাভ করা সম্ভব হবে না।
গারোবাজারের মো: মঞ্জুর রহমান মিন্টু বলেন, এবার কাঁঠালের কোনো ব্যাপারীই আসে নাই দাম করতে। অথচ গত বছর ওই বাগানের কাঁঠাল বেশ চরা দামেই বিক্রি করেছিলাম। তারা দু’জনেই একমত যে, কাঁঠালে রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোর কারণে তারা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ যেন নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মতো অবস্থা।
গারোবাজার বণিক সমিতির সভাপতি বলেন, এ বছর কাঁঠালের মৌসুম শুরু হয়েছে একটু দেরিতে। তবে কচি কাঁঠালে বিষাক্ত রাসায়নিক দেয়া ভালো লক্ষণ নয়। এর প্রতিকার হওয়া প্রয়োজন।
কথা হয় কাঁঠাল ব্যবসায়ী সাহেব আলীর সাথে, তিনি প্রতি বছর গারোবাজার থেকে কাঁঠাল কিনে ঢাকাসহ জেলার বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করেন। তিনি বলেন, অন্য বছরের তুলনায় কাঁঠালের আমদানি কম, প্রচণ্ড গরমে মানুষ কাঁঠাল খেতে চায় না।
এক ট্রাক কাঁঠাল ঢাকার বাজার পর্যন্ত নিতে গাড়ি ভাড়াসহ খরচ পরে প্রায় পনেরো হাজার টাকা। হাট-বাজারগুলোতে দালাল, ফড়িয়াদের উৎপাতে অতিষ্ঠ এলাকার কাঁঠালচাষিরা।
বর্তমানে এ ব্যবস্থায় কাঁঠাল পাকানোর ফলে নষ্ট হতে চলেছে মধুপুরের কাঁঠালের সুনাম। পাশাপাশি কাঁঠালের বাজার হচ্ছে মন্দা এবং ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কৃষক। স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী এসব রসায়নিক দ্রব্য মিশ্রিত কাঁঠাল খেলে আমাশয়, লিভারের রোগ, রাতকানা, শ্বাসকষ্ট, লিভার নষ্ট হওয়া, অ্যাজমা ও ক্যান্সারের মতো জটিল রোগ হতে পারে।
সম্প্রতি সরকারের ভেজালবিরোধী অভিযান চললেও থেমে নেই কাঁঠালে রাসায়নিক মেশানো। বহুকাল আগে থেকেই মধুপুরের আনারস ও কাঁঠালের রয়েছে দেশব্যাপী ঐতিহ্য সুনাম। কিন্তু একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী দালাল ফরিয়াদের কারণে সেই সুনাম ক্ষুণ্ণ হতে চলেছে। সূত্র : নয়া দিগন্ত