আত্মশুদ্ধির মাস
মুমিন জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার রমজান। আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংযমের মাধ্যমে আত্ম উন্নয়নের চেতনায় জীবনের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের জন্য করুণাময় আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমতের অফুরান ভান্ডার নিয়ে আসে রমজান। প্রিয় নবি (সা.) এ মাসকে ‘শাহরুন আজিম’ মহান সম্মানিত মাস এবং ‘শাহরুম মোবারক’ বরকতময় মাস নামে আখ্যায়িত করেছেন।
নবি কারিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানসহ সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখবে, তার অতীতের সব গুনাহ ক্ষমা করা হবে। আর যে ব্যক্তি ইমানসহ সওয়াবের আশায় কিয়ামে রমজান অর্থাৎ তারাবির নামাজ আদায় করবে, তার পূর্ববর্তী গোনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হবে। আর যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় শবেকদরে রাত জেগে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করবে তারও পূর্ববর্তী গুনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হবে। (বোখারি শরিফ ১/২৫৫, মুসলিম শরিফ ১/২৫৯, মেশকাত শরিফ ১/১৭৩)।
তাৎপর্য
হজরত সালমান ফারসি (রা.) বর্ণনা করেন, শাবান মাসের শেষ দিনে নবি কারিম (সা.) মিম্বরে বসে বলেন, হে লোকজন! তোমাদের ওপর এক মহা ও বরকতময় মাস আগত প্রায়। এমন মাস, যার মধ্যে এমন একটি রাত (শবেকদর) আছে যা হাজার মাস থেকে উত্তম। (অর্থাৎ ওই এক রাতের ইবাদতের সওয়াব হাজার মাসের থেকে বেশি) আল্লাহতায়ালা এ মাসে দিনেরবেলা রোজা ফরজ করেছেন আর রাতে ইবাদতকে করেছেন নফল। এ মাসে যে ব্যক্তি নেক আমলের দ্বারা আল্লাহতায়ালার নৈকট্য অর্জনে প্রত্যাশী হবে, তার অবস্থা এরূপ যে, কেমন যেন সে অন্য মাসে ফরজ আদায় করেছে। অর্থাৎ নফলের সওয়াব ফরজের সমতুল্য হবে। আর যে ব্যক্তি এ মোবারক মাসে কোনো ফরজ আদায় করবে তার অন্য মাসে সত্তরটি ফরজ আদায়ের সমান সওয়াব হবে।
অর্থাৎ রমজানে এক ফরজের সওয়াব সত্তর গুণ বেড়ে যায়। রমজান সবরের মাস, আর সবরের সওয়াব ও বদলা হলো জান্নাত। এ মাস মানুষের সঙ্গে সদাচার ও কল্যাণকামিতার মাস। এ মাসে মুমিনের রিজিক বৃদ্ধি করা হয়। যে ব্যক্তি এ মাসে কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে তার গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। আর জাহান্নাম থেকে মুক্তির পরওয়ানা মিলবে। সঙ্গে সঙ্গে রোজাদারের সওয়াব কম করা ছাড়াই ইফতার করানো ব্যক্তি রোজার অনুরূপ সওয়াব লাভ করবে। এ কথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আমাদের মধ্যে অনেক মানুষ এমন রয়েছে, যাদের এ সামর্থ্য নেই যে, তারা অন্যকে ইফতার করাবে, আর এমন সওয়াব লাভ করবে। এ প্রশ্ন শুনে নবি কারিম (সা.) এমন জওয়াব দিলেন যা শুনে তাদের হতাশা ও কষ্টগুলো আশা এবং আনন্দে পরিণত হলো। তিনি (সা.) বললেন, আল্লাহতায়ালা এসব পুরস্কার ওইসব ব্যক্তিদেরও দেবেন, যারা কোনো রোজাদারকে এক ঢোক দুধ, একটি খেজুর, এমনকি এক ঢোক পানি পান করাবে। তবে যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে পেট ভরে খাওয়াবে আল্লাহতায়ালা তাকে কেয়ামতের দিন আমার হাউজে কাওসার থেকে এমন পানি পান করাবেন যে, তারপর চিরস্থায়ী জান্নাতে প্রবেশের আগে তার আর পিপাসা লাগবে না। এরপর নবি কারিম (সা.) বলেন, রমজান এমন মাস, যার প্রথম দশক রহমত, দ্বিতীয় দশক মাগফিরাত আর শেষ দশক জাহান্নাম থেকে মুক্তির। যে ব্যক্তি এ মাসে তার গোলাম (কর্মচারী, চাকর, এক কথায় অধীনস্থ প্রত্যেক ব্যক্তি) থেকে কাজের বোঝা বা দায়িত্ব হালকা করে দেবে আল্লাহতায়ালা তাকে ক্ষমা করে দেবেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন। হে লোকজন! এ মাসে চারটি জিনিসের ওপর খুব গুরুত্ব দাও এবং বেশি বেশি করে করো। ১. কালিমা তাইয়্যেবা-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ। ২. ইস্তিগফার তথা ক্ষমা প্রার্থনা। ৩. জান্নাত চাওয়া। ৪. জাহান্নাম থেকে মুক্তি কামনা করা। (মেশকাত শরিফ : ১/১৭৪, বায়হাকি, শুয়াবুল ইমান ৩/৩০৫)।
প্রতিদান
মহানবি (সা.) বলেন, ‘রোজার প্রতিদান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নিজেই দেবেন এবং বিনা হিসাবে দেবেন।’ [বোখারি শরিফ হাদিস ১৮৯৪]। আল্লাহতায়ালা রোজাদারকে কিয়ামতের দিন পানি পান করাবেন। [মুসনাদে বাজজার হাদিস : ১০৩৯]। ‘রোজা হলো জান্নাত লাভের পথ’। [মুসনাদে আহমদ, হাদিস ২৩৩২৪]। ‘রোজা জাহান্নাম থেকে রক্ষাকারী ঢাল ও দুর্গ’। [মুসনাদে আহমদ হাদিস, ১৪৬৬৯]। ‘রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের চেয়েও সুগন্ধিযুক্ত। [বুখারি হাদিস-১৯০৪]। এ ছাড়া আরও অনেক হাদিসে রোজার বিশেষ ফজিলতের কথা বর্ণিত হয়েছে।
রোজার নিয়ত
রোজার নিয়তের জন্য মুখ দিয়ে নির্ধারিত শব্দ বা বাক্য উচ্চারণ করা জরুরি নয়। বরং অন্তরের ইচ্ছাই যথেষ্ট। এমনকি রোজার জন্য সেহরি খাওয়াটাও নিয়তের স্থলাভিষিক্ত। কিছু লোক আরবিতে রোজার নিয়ত করাকে আবশ্যকীয় মনে করে থাকেন অথচ তা সঠিক নয় (জাওয়াহিরুল ফিক্হ ১/৩৭৮)। তবে আরবি নিয়ত করলে অসুবিধা নেই।
প্রত্যেক রোজার জন্য ভিন্ন ভিন্ন নিয়ত করা জরুরি (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া ১/১৯৫)। অর্ধ দিনের আগে নিয়ত করলে রোজা বিশুদ্ধ হয়ে যাবে (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া ১/১৯৫)।
আরবিতে : নাওয়াইতু আন আছুমা গাদাম মিন শাহরি রমাদানাল মুবারাকি ফারদাল্লাকা, ইয়া আল্লাহু ফাতাকাব্বাল মিন্নি ইন্নাকা আনতাস সামিউল আলিম।
বাংলায় : হে আল্লাহ! আমি আগামীকাল পবিত্র রমজানের তোমার পক্ষ থেকে নির্ধারিত ফরজ রোজা রাখার ইচ্ছা পোষণ (নিয়্যত) করলাম। অতএব, তুমি আমার পক্ষ থেকে (আমার রোজা তথা পানাহার থেকে বিরত থাকাকে) কবুল কর, নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী।
রোজা ভঙ্গের কারণগুলো
রোজা অবস্থায় অসুস্থতার কারণে ইনহেলার (Inhelar) ব্যবহারের দ্বারা রোজা ভেঙে যায় [শামি ৩/৩৬৬]। রোজা অবস্থায় ইচ্ছাকৃত বমি করা বা মুখে বমি চলে আসার পর তা পরিমাণে অল্প হলেও ইচ্ছাকৃত গিলে ফেললে রোজা ভেঙে যাবে [মুসান্নাফে আব্দুর রাজজাক ৪/১৯৭]। যদি নাশিকা দিয়ে রক্ত বের হওয়ার পর মুখে চলে যায়, তাহলে রোজা ভেঙে যাবে [তাতারখানিয়া ৩/৩৮৩]। রোজাদার যদি মুখে পান রেখে ঘুমিয়ে পড়ে আর এমতাবস্থায় সুবহে সাদিক হয়ে যায় ও পানের কিছু অংশ পেটে চলে যায়, তাহলে তার রোজা হবে না। পরে কাজা করতে হবে। কাফফারা দেওয়া লাগবে না [শামি ৩/৩৭৪]। কুলি করার সময় যদি অনিচ্ছাকৃত পানি গলা দিয়ে পেটে চলে যায় তাহলে রোজা কাজা করতে হবে। কাফফারা ওয়াজিব হবে না। আর যদি রোজার কথা স্মরণই না থাকে, পানি মুখে নিয়ে খেয়ে ফেলে তাহলে রোজা ভাঙবে না [তাতারখানিয়া ৩/৩৭৮]। নাক অথবা কানের মধ্যে তেল দেওয়ার দ্বারা রোজা ভেঙে যাবে। তবে কাফফারা ওয়াজিব হবে না [হেদায়া ১/২২০]। যদি কোনো ব্যক্তি কারও ধমকের কারণে অথবা ভুল করে যেমন রোজার কথা ভুলে গিয়ে পানাহার করে অতঃপর রোজা ভেঙে গেছে মনে করে ইচ্ছা করে পানাহার করল, তাহলে রোজা নষ্ট হয়ে যাবে এবং কাজা করা জরুরি [মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা ৬/১৪৯]। পাথরের কণা, মাটি, ঘাস, কাগজ ইত্যাদি মোটকথা যা সাধারণ আহারযোগ্য নয় বা কোনো উপকারে আসে না তা খেলেও রোজা ভেঙে যাবে এবং কাজা করতে হবে [বাযযাযিয়া, ৪/৯৯]। দাঁত থেকে রক্ত বের হয়ে যদি থুতুর সঙ্গে ভেতরে চলে যায়। আর রক্তের পরিমাণ যদি থুতুর সমান বা বেশি হয় তাহলে রোজা ভেঙে যাবে [বোখারি ১/২৬০]। বিড়ি সিগারেট, হুঁকা পান করলে রোজা ভেঙে যাবে এবং কাজা করা জরুরি [শামি ৩/৩৬৬]।
কঠিন অসুস্থতার ফলে যদি কোনো মানুষ রোজা ভেঙে ফেলে, তাহলে শুধু কাজা করতে হবে। কাফফারা দেওয়া লাগবে না [তাবয়ীনুল হাকায়েক ২/১৮৯]। যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত রোজা ভেঙে ফেলে অতঃপর খুব অসুস্থ হয়ে যায় অথবা কোনো নারীর প্রিয়ড হয়, তাহলে শুধু কাজা করতে হবে। কাফফারা দেওয়া লাগবে না [হিন্দিয়া ১/২০৬]। রোজা অবস্থায় স্ত্রীর সঙ্গে তার স্বামী জোর করে সহবাস করলে স্ত্রীকে শুধু কাজা আদায় করতে হবে। কাফফারা নয় [তাতারখানিয়া ৩/৩৯৪]। যদি কোনো ব্যক্তি রোজা অবস্থায় সফর করে তার জন্য কোনো ওজর ছাড়া রোজা ভেঙে ফেলা অনুচিত। যদি ভেঙে ফেলে তাহলে শুধু কাজা জরুরি, কাফফারা নয় [আলমগিরি ১/২০৬]। যদি কোনো পুরুষের প্রস্রাবের রাস্তায় কোনো ওষুধ দেওয়া হয় আর অণ্ডকোষ পর্যন্ত পৌঁছে, তাহলে রোজা ভেঙে যাবে অন্যথায় নয় [তাবয়ীনুল হাকায়েক ২/১৮৩]। কোনো নারীর লজ্জাস্থানে ওষুধ লাগানোর সঙ্গে সঙ্গেই রোজা ভেঙে যাবে [বাহরুর রায়েক ২/৪৮৮]।
ভঙ্গ হয় না যেসব কারণে
ভুল করে কোনো কিছু খেয়ে ফেললে রোজা ভঙ্গ হবে না [বোখারি শরিফ ১/২৫৯]। মশা-মাছি, কীটপতঙ্গ ইত্যাদি অনিচ্ছাকৃত পেটের ভেতর ঢুকে গেলেও রোজা ভাঙবে না [মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা ৬/৩৪৯]। অনিচ্ছাকৃত বমি হলে [এমনকি মুখ ভরে হলেও] রোজা ভাঙবে না। তেমনি বমি মুখে এসে নিজে নিজেই ভেতরে চলে গেলেও রোজা ভাঙবে না [তিরমিজি ১/১৫৩]। রোজার কথা ভুলে গিয়ে পানাহার করলে রোজা নষ্ট হবে না। তবে রোজা স্মরণ হওয়ামাত্র পানাহার ছেড়ে দিতে হবে [মুসলিম ১/২০২]। দাঁত থেকে রক্ত বের হয়ে পেটের মধ্যে না গেলে রোজা ভাঙবে না [শামি ৩/৩৬৭]। কোনো খাদ্যদ্রব্য বুট বা ছোট ছোলার কম পরিমাণ যদি দাঁতের সঙ্গে লেগে থাকে ও গলার ভেতর চলে যায়, তাহলে রোজা ভাঙবে না [হিন্দিয়া ১/২০২]। হ্যাঁ, দাঁত থেকে বের করে হাতে নিয়ে স্বেচ্ছায় খেয়ে ফেললে রোজা নিশ্চিতভাবে ভেঙে যাবে [হিন্দিয়া ১/২০২]। অতিরিক্ত গরম বা পিপাসার কারণে যদি গোসলের মাধ্যমে শরীরকে ঠান্ডা করে তাহলেও রোজার কোনো ক্ষতি হবে না [হিন্দিয়া ১/২০৩]। কুলি করার পর পানির অবশিষ্ট আর্দ্রতা থুতুর সঙ্গে গিলে ফেললে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না [হিন্দিয়া ১/২০৩]। ঘাম অথবা চোখের অশ্রুর দু-এক ফোঁটা যদি অনিচ্ছায় মুখে চলে যায়, তাহলে রোজা নষ্ট হবে না [হিন্দিয়া ১/২০৩]। কানের ময়লা বের করার দ্বারাও রোজা ভাঙবে না [মারাকিল ফালাহ ৩৪২]। যদি পান খাওয়ার পর খুব ভালোভাবে কুলি করার পরও রোজা অবস্থায় থুতুর সঙ্গে লাল রং বের হয়, তাহলে কোনো সমস্যা নেই [হিন্দিয়া ১/২০৩]। নাক এত জোরে সাফ করা, যার ফলে কফ গলার মধ্যে চলে যায়, তাহলেও কোনো সমস্যা নেই [দুররে মুখতার ৩/৩৭৩]। রোজা অবস্থায় আতর বা ফুলের ঘ্রাণ নিলেও কোনো সমস্যা নেই [মারাকিল ফালাহ, ৩৬১]। শরীর বা মাথায় তেল ব্যবহার করলে রোজা ভাঙবে না, বরং তা বৈধ [মুসান্নাফে আব্দুর রাজজাক ৪/৩১৩]। রোজা অবস্থায় অনিচ্ছাকৃত মুখের মধ্যে ধুলাবালি ঢুকে গেলে রোজা ভাঙবে না [দুররে মুখতার ৩/৩৬৬]। যদি রোজাদারের গোসল করার সময় অথবা বৃষ্টিতে ভেজার সময় কানের মধ্যে অনিচ্ছায় পানি চলে যায়, তাহলে সর্বসম্মতিক্রমে রোজা নষ্ট হবে না [ফাতহুল কাদির ২/৩৪৭]। সুস্থ অবস্থায় রোজার নিয়ত করার পর যদি অজ্ঞান, অচেতন বা পাগল হয়ে যায়, তাহলে রোজা নষ্ট হবে না [সুনানে কুবরা বায়হাকি ৪/২৩৫]।
বরকতময় সেহরি
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) নবি (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, সেহরি খাওয়ার মাধ্যমে দিনের রোজা পূর্ণ করার জন্য সাহায্য নাও এবং দুপুরে ঘুমের মাধ্যমে রাতের নামাজের জন্য সাহায্য নাও।’ (ইবনে মাজাহ : ১৬৯৩)। পেটে ক্ষুধা না থাকলেও সেহরি খাওয়া উচিত।
হজরত আবু সাঈদ (রা.) থেকে বর্ণিত-হাদিসে নবি (সা.) বলেছেন, ‘সেহরি খাওয়া বরকত। একে পরিত্যাগ করো না, যদিও এক ঢোক পানির মাধ্যমে হয়। আল্লাহ ও ফেরেশতা সেহরি ভক্ষণকারীদের জন্য রহমতের দোয়া করেন।’ (মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল : ১১১০১)।
যদি কোনো ব্যক্তি সেহরি খাওয়া ছাড়াই রোজার নিয়ত করে নেয়, তথাপিও তার রোজা হয়ে যাবে। তবে সে সেহরির বরকত পাবে না। [শামী ৩/৪০০]।
ইফতারের ফজিলত
ইফতারের সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করা উত্তম। ইফতারের আগেই ইফতারি সামনে নিয়ে অপেক্ষা করা এবং যথাসময়ে ইফতার করা সুন্নাত। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে রোজাদারের দোয়া আল্লাহর কাছে এতই আকর্ষণীয় যে আল্লাহতায়ালা রমজানের সময় ফেরেশতাদের উদ্দেশে ঘোষণা করেন, ‘রমজানে তোমাদের পূর্বের দায়িত্ব মওকুফ করা হলো এবং নতুন দায়িত্বের আদেশ করা হলো, তা হলো আমার রোজাদার বান্দারা যখন কোনো দোয়া মোনাজাত করবে, তখন তোমরা আমিন! আমিন!! বলতে থাকবে।’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক)।
মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘রোজাদারের জন্য দুটি খুশি; একটি ইফতারের সময়, অপরটি আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়।’ (মুসলিম)। হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘আমার বান্দাদের মধ্যে তারা আমার বেশি প্রিয়, যারা দ্রুত ইফতার করে।’ (তিরমিজি, আলফিয়্যাতুল হাদিস : ৫৬০, পৃষ্ঠা : ১৩১)।
কী দিয়ে ইফতার করব
খেজুর দিয়ে ইফতার করা সুন্নাত; যে কোনো ফল দ্বারা ইফতার করলেও সুন্নাত আদায় হবে। মিষ্টান্ন দ্বারা ইফতার করলেও সুন্নাত পালন হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ রোজা রাখলে খেজুর দিয়ে যেন ইফতার করে, খেজুর না হলে পানি দ্বারা; নিশ্চয়ই পানি পবিত্র।’ (তিরমিজি ও আবু দাউদ; আলফিয়্যাতুল হাদিস : ৫৬২, পৃষ্ঠা : ১৩১-১৩২)।
ইফতার করানোর সওয়াব
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার গুনাহ মাফ হয়ে যাবে, সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করবে এবং রোজাদারের সওয়াবের সমপরিমাণ সওয়াব সে লাভ করবে। তবে ওই রোজাদারের সওয়াব কম করা হবে না।’ সাহাবায়ে কিরাম বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.)! আমাদের অনেকেরই রোজাদারকে ইফতার করানোর সামর্থ্য নেই।’ রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘পানিমিশ্রিত এক পেয়ালা দুধ বা একটি খেজুর অথবা এক ঢোক পানি দ্বারাও যদি কেউ কোনো রোজাদারকে ইফতার করায়, তাতেও সে পরিমাণ সওয়াব পাবে। আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে তৃপ্তিসহকারে আহার করাবে, আল্লাহতায়ালা তাকে আমার হাউজে কাউসার থেকে এমন পানীয় পান করাবেন, যার ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করার পূর্ব পর্যন্ত তৃষ্ণার্ত হবে না।’ (মুসনাদে আহমাদ)।
ইফতারের দোয়া
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা লাকা ছুমতু ওয়া আলা রিযক্বিকা ওয়া আফতারতু বিরাহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমিন।
অর্থ : হে আল্লাহ! আমি তোমারই সন্তুষ্টির জন্য রোজা রেখেছি এবং তোমারই দেওয়া রিজিকের মাধ্যমে ইফতার করছি।
তারাবিহের নামাজ
রমজানে এশার নামাজের পর বিশ রাকাত তারাবিহ দশ সালামের সঙ্গে আদায় করা পুরুষ ও মহিলা সবার জন্য সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্ [দুররে মুখতার ২/৪২৯]।
তারাবিহের নিয়ত
তারাবিহের নামাজ এবং সব সুন্নাত ও নফল নামাজের জন্য সাধারণভাবে নামাজের নিয়ত করলেও যথেষ্ট। এতদসত্ত্বেও সতর্কতাবশত তারাবিহ নামাজের জন্য অন্তরে ইচ্ছা পোষণ করে নেওয়া উত্তম [দুররে মুখতার২/৮৬]। তারাবিহের মধ্যে কমপক্ষে একবার কুরআন খতম করা সুন্নাত। আর একবারের অধিকবার পড়া মুস্তাহাব [দুররে মুখতার ২/৪৩৩, আলমগিরী ১/১৭৭]।
ইতিকাফ
হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রাত শবেকদর। প্রত্যেক মুমিনের উচিত এ রাতে ইবাদত বন্দেগি করে খোদার সন্তুষ্টি অর্জন করা। হজরত উমর (রা.) বর্ণনা করেন-নবি কারিম (সা.) রমজান মাসের শেষ দশকে ইতিকাফ করেছেন (বুখারি, মুসলিম)। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন-আল্লাহর রাসূল (সা.) রমজানের মধ্যের দশকে ইতিকাফ করতেন। এক বছর এভাবে ইতিকাফ করছিলেন যখন একুশের রাত এলো, যে রাতের সকালে তিনি তার ইতিকাফ থেকে বের হবেন, তখন তিনি বললেন, যারা আমার সঙ্গে ইতিকাফ করেছে, তারা যেন শেষ দশকেও ইতিকাফ করে। আমাকে স্বপ্নে এ রাত (শবেকদর) দেখানো হয়েছিল, পরে আমাকে তা (সঠিক তারিখ) ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
অবশ্য আমি স্বপ্নে দেখতে পেয়েছি যে, ওই রাতের সকালে আমি কাদাপানির মাঝে সিজদা করছি। তোমরা তা শেষ দশকে তালাশ কর এবং প্রত্যেক বিজোড় রাতে তালাশ কর। পরে এ রাতে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হয়। মসজিদের ছাদ ছিল খেজুর পাতার ছাউনির। ফলে মসজিদে টপটপ করে বৃষ্টি পড়তে লাগল। একুশের রাতের সকালে আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর কপালে কাদাপানির চিহ্ন আমার এ দুচোখ দেখতে পায় [বোখারি শরিফ]। এ জন্য প্রত্যেক শবেকদর সন্ধানকারীর উচিত রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা।
ইতিকাফের পরিচয়
শরিয়তের পরিভাষায় ইতিকাফ বলা হয়-ইতিকাফের নিয়তে পুরুষের এমন মসজিদে অবস্থান করা যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা হয় এবং কোনো মহিলার নিজ গৃহে নামাজের স্থানে অথবা ঘরের এক কোণে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে।
মহিলাদের ইতিকাফ
কোনো মহিলা ইতিকাফ করতে চাইলে সে বাড়ির কোনো একটি কামরায় ইতিকাফ করতে পারে। আর ওই কামরা তার জন্য মসজিদের মতো। অর্থাৎ ওই কামরা থেকে প্রয়োজন ছাড়া বের হতে পারবে না। যদি বের হয়, তাহলে ইতিকাফ ভেঙে যাবে [আলমগিরী ১/২১১]।
আধুনিক মাসআলা
চোখে ওষুধ, ড্রপ বা সুরমা ইত্যাদি লাগালে রোজার কোনো ক্ষতি হয় না। [আবু দাউদ-১/৩৩২]। রোজা অবস্থায় শরীর থেকে রক্ত বের করে টেস্ট বা পরীক্ষা করালে রোজা ভঙ্গ হয় না। [আলমগিরি ১/১৯৯]। হৃৎপিণ্ডের অসুস্থতার ফলে যে ওষুধ জিহ্বার নিচে রাখা হয় তার দ্বারা রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। তবে তা বিগলিত হয়ে থুতুর সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে গলা বা পেটের মধ্যে ঢুকে গেলে রোজা ভেঙে যাবে [শামি ৩/৩৬৭]। যদি রোজা অবস্থায় এমন ইঞ্জেকশন গ্রহণ করে যা পেটের মধ্যে অথবা মস্তিষ্কের মধ্যে চলে যায়, তাহলে রোজা ভেঙে যাবে [জাওয়াহিরুল ফিকহ ১/৩৭৯]। শরীরে স্যালাইন লাগানোর দ্বারা রোজা নষ্ট হবে না। তবে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া দেওয়া অনুচিত [তাতারখানিয়া ৩/৩৭৯]। ডায়ালাইসিস করার দ্বারা রোজা ভঙ্গ হবে না [তাতারখানিয়া ৩/৩৭৯]। রোজা অবস্থায় অক্সিজেন নেওয়ার দ্বারা রোজা নষ্ট হয় না [আয়েনায়ে রমজান ৬৫]। হোমিওপ্যাথিক ওষুধের ঘ্রাণ নেওয়ার দ্বারা রোজা ভঙ্গ হয় না [মারাকিল ফালাহ ৫৪৩]। যদি পেট পরীক্ষা বা টেস্টের জন্য পেটের মধ্যে নাক বা গলা দিয়ে কোনো নল প্রবেশ করানো হয় আর তার মধ্যে কোনো ওষুধ মিশ্রিত করা হয়, তাহলে রোজা নষ্ট হয়ে যাবে [মুফতিরাতিস সিয়ামুল মুআ’সারাহ ৪৫-৫২]।
মাকরুহ হয়ে যায়
রোজা অবস্থায় মুখের মধ্যে থুতু জমা করা [হিন্দিয়া ১/১৯১]। বিনা প্রয়োজনে কোনো কিছুর স্বাদ নেওয়া বা চিবানো (শামি ৩/৩৯৫)। টুথপেস্ট অথবা কোনো মাজন দ্বারা দাঁত পরিষ্কার করা (শামি ৩/৩৯৫)। প্রত্যেক ভারী কাজ যার ফলে রোজা ভেঙে ফেলার উপক্রম হয় [দুররে মুখতার ৩/৪০০]। রোজা অবস্থায় গুনাহের কাজ করা [তিরমিজি ১/১৫০]। কুলি করা ও নাকে পানি দেওয়ার সময় অতিরঞ্জন করা [হিন্দিয়া ১/১৯৯]। সন্দেহযুক্ত সময়ে সেহরি করা [হিন্দিয়া ১/২০০]। স্বামীর অনুমতি ছাড়া স্ত্রীর নফল রোজা রাখা [হিন্দিয়া ১/২০১]। রোজা অবস্থায় লিপস্টিক দেওয়া মাকরুহ। কেননা তা মুখের মধ্যে চলে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। তবে মাথায় মেহেদি লাগানোতে কোনো সমস্যা নেই (তাতারখানিয়া ৩/৩৯৫)।