বঙ্গনিউজবিডি ডেস্ক: প্রায় বছর দেড় আগে টেকনাফের মেরিন ড্রাইভের শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান।
সেনাবাহিনীর কঠিন নিয়মতান্ত্রিক জীবন থেকে অবসর নিয়ে সিনহা ছুটে বেড়াতেন ভ্রমণের নেশায়। সেই নেশাতেই সেদিন তিনি গিয়েছিলেন কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভে।
তারিখটা ছিলো ২০২০ সালের ৩১ জুলাই। সেদিন রাতেই টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নির্মমভাবে নিহত হন সেনাবাহিনীর সাবেক অফিসার সিনহা। আলোচিত এ হত্যার তদন্তে র্যাবের দেওয়া অভিযোগপত্রে বিস্তারিত উঠে আসে সেদিনের ঘটনা।
সেদিনের ঘটনার একমাস আগে থেকেই সিনহা এক মাস যাবত অবস্থান করছিলেন কক্সবাজারের হিমছড়িতে। ‘জাস্ট গো’ নামের একটি ভ্রমণ বিষয়ক ডকুমেন্টারি বানাতে সিনহার সঙ্গে ছিলেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী সাহেদুল ইসলাম সিফাত, শিপ্রা দেবনাথ আর তাহসিন রিফাত নূর।
ঘটনার দিন বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে সিফাতকে সঙ্গে নিয়ে হিমছড়ির নীলিমা রিসোর্ট থেকে বের হয়ে যান সিনহা। নিজের গাড়ি চালিয়ে মুইন্না পাহাড়ের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন সিনহা। সেদিন পথঘাট ছিলো একেবারেই ফাঁকা। বেরোনোর সময় সিনহার পরনে ছিল কম্ব্যাট প্যান্ট আর টি-শার্ট, সঙ্গে ছিল ক্যামেরাসহ তার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি।
ঐ বিকালে একটি ‘টাইমল্যাপস’ ভিডিও ধারণের জন্য পাহাড়ের ওপর থেকে সাগর আর আশপাপাশের দৃশ্য ধারণ করছিলেন সিনহা এবং তার সঙ্গী সিফাত। এক সময় বেলা পড়ে গিয়ে দিনের আলো ফিকে হয়ে নেমে আসে অন্ধকার।
এই সময়ই টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ এবং বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলী নির্দেশে মেজর সিনহার দলের সম্পর্কে খোঁজ রাখতে নির্দেশ দেয়া স্থানীয় পুলিশের সোর্স নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দীন এবং মোহাম্মদ আইয়াজ জানতে পারেন দুজন লোক ভিডিও করতে পাহাড়ে উঠেছেন। তাদের একজনের পরনে সেনাবাহিনীর মতো পোশাক রয়েছে।
র্যাবের অভিযোগপত্রে বলা হয়, সুযোগ পেলে ‘ডাকাত’ বলে প্রচার করে ওই ‘ভিডিও পার্টি’কে গণপিটুনি দেওয়ার নির্দেশনাও দিয়েছিলেন প্রদীপ। সে অনুযাযী ওই তিন সোর্স সিনহা ও তার সঙ্গীকে ডাকাত সাব্যস্ত করার ফন্দি আঁটেন।
তারা প্রথমে মুইন্না পাহাড়ের কাছে দক্ষিণ মারিশাবুনিয়া জামে মসজিদের মাইকে ‘পাহাড়ে ডাকাত দেখা যাচ্ছে’ বলে ঘোষণা দেন। ঘোষণা শুনে লোকজন জড়ো হয়, কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তারা চলে যায়।
রাত ৮টার দিকে পুলিশের তিন সোর্স মাথাভাঙ্গা মসজিদের ইমাম জহিরুলকে ডাকাতের ঘোষণা দিতে বলেন। বর্ণনা শুনে ইমাম জানান, যাকে ডাকাত বলা হচ্ছে তিনি সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর, পাহাড়ে ওঠার সময় তার সঙ্গে দেখা হয়েছে।
তখন পাহাড় থেকে নেমে আসছিলেন মেজর সিনহা ও তার সঙ্গী সিফাত। পুলিশের ঐ তিন সোর্স তাদের মুখে টর্চের আলো ফেলে নিশ্চিত হন, এদেরই খুঁজছিলেন ওসি প্রদীপ।
তারা সিনহা আর সিফাতের পিছু পিছু মেরিন ড্রাইভ পর্যন্ত আসেন। সিনহা নিজের গাড়িতে উঠলে রাত ৮টা ৪৭ মিনিটে সোর্স নুরুল আমিন বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত আলীকে ফোন করে সিনহার বিষয়ে জানান যে, সিনহা গাড়ি চালিয়ে কক্সবাজারের দিকে যাচ্ছেন। ঐ রাতে পরের তিন ঘণ্টায় নুরুলের সঙ্গে ১৫ বার ফোনালাপ হয় লিয়াকতের।
নুরুলের ফোন পাওয়ার পরপরই পরিদর্শক লিয়াকত আলী সঙ্গে কোনো ফোর্স না নিয়েই এসআই নন্দদুলাল রক্ষিতের মোটরসাইকেলের পেছনে করে শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে হাজির হয়ে অস্ত্রসহ অবস্থান নেন।
মেরিন ড্রাইভে পরপর বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) চেকপোস্টের অবস্থান। সিনহার গাড়িটি রাত ৯টা ২০ মিনিটের দিকে বিজিবি চেকপোস্ট অতিক্রম করে।
ওই চেকপোস্টে সিনহার পরিচয় পেয়ে স্যালুট দিয়ে তাকে যেতে দেন বিজিবি সদস্যরা। এর পাঁচ মিনিট পরই গাড়িটি শামলাপুর চেকপোস্টে পৌঁছায়। সেখানেও নিয়মানুযায়ী গাড়িটি থামার সংকেত দেয়া হয়।
এপিবিএনের কনস্টেবল রাজীব পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে চালকের বাঁয়ের আসনে বসা সিফাত জানালা খুলে দেন। চালকের আসনে বসা সিনহা নিজের পরিচয় দেন এবং পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। রাজীব এবং অন্য দুই এপিবিএন সদস্য এসআই শাহজাহান আলী এবং কনস্টেবল আবদুল্লাহ আল-মামুন স্যালুট দিয়ে গাড়িটিকে চলে যাওয়ার সংকেত দেন।
এসময় পরিদর্শক লিয়াকত গাড়ির পেছনে দাঁড়ানো ছিলেন। মেজর সিনহার পরিচয় শোনা মাত্রই তিনি চিৎকার করে গাড়ির সামনে আসেন এবং আবার তাদের পরিচয় জিজ্ঞেস করেন। সিনহার নাম শুনে লিয়াকত উত্তেজিত হয়ে সামনে গিয়ে ব্যরিকেড টেনে রাস্তা বন্ধ করে দেন।
সেসময় এপিবিএন সদস্যরাও লিয়াকতকে রাস্তা আটকাতে সহায়তা করেন। পরিদর্শক লিয়াকত আলী গাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে পিস্তল তাক করে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে চেঁচামেচি ও গালাগালি করতে থাকেন।
আরোহীদের দুই হাত উপরে তুলে নামতে বলেন লিয়াকত। চিৎকার-হইচই শুনে রাস্তার দুই পাশে লোকজন দাঁড়িয়ে যান। উজ্জ্বল আলোয় আশপাশের মসজিদ এবং বাজার থেকেও অনেকে এ ঘটনা দেখেন।
ঐ সময় পরিদর্শক লিয়াকত আলী খুবই উত্তেজিত ছিলেন। পুলিশের নির্দেশ পেয়ে সিনহার সঙ্গী সিফাত দুই হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নামেন। আর চালকের আসনে বসা সিনহা দুই হাত উঁচু করে নেমে ইংরেজিতে ‘কামডাউন, কামডাউন’ বলে লিয়াকতকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। এসময় সিনহাকে প্রথমে দুই রাউন্ড এবং কয়েক কদম এগিয়ে আরও দুই রাউন্ড গুলি করেন লিয়াকত। এরপরই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন সিনহা। গুলি করার পর সিনহা ও সিফাতকে হাতকড়া পরানোর নির্দেশ দেন লিয়াকত আলী। এসআই নন্দ দুলাল গুলিবিদ্ধ সিনহাকে এ সময় হাতকড়া পরান।
কিন্তু এসআই শাহাজাহানের কাছে হাতকড়া না থাকায় বকাবকি করেন লিয়াকত। বাজার থেকে রশি এনে সিফাতকে বাঁধতে বলেন। কনস্টেবল আব্দুল্লাহ শামলাপুর বাজার থেকে রশি কিনে আনলে এপিবিএনের তিন সদস্য সিফাতকে বাঁধেন।
এদিকে রাত সাড়ে ৯টার দিকে ওসি প্রদীপকে ফোনে ঘটনা জানান পরিদর্শক লিয়াকত। তাদের মধ্যে এক মিনিট ১৯ সেকেন্ড কথা হয়। ৯টা ৩৩ মিনিটে কক্সবাজারের পুলিশ সুপারকে ফোন করে কথা বলেন লিয়াকত।
র্যাবের দেয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়, মেজর সিনহা তখনও জীবিত ও সচেতন ছিলেন- ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন তিনি, পানির জন্য মিনতি করছিলেন। লিয়াকত তখন উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘তোকে গুলি করেছি কী পানি খাওয়ানোর জন্য’। “এরপর গুলিবিদ্ধ সিনহার বুকের বামপাশে জোরে জোরে লাথি মারেন এবং পা দিয়ে মাথা চেপে ধরেন লিয়াকত।”
ইতোমধ্যে এসআই নন্দদুলাল বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রে ফোন করে আরও কিছু পুলিশ পাঠাতে বলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তদন্ত কেন্দ্র একটি সিএনজি অটোরিকশায় এএসআই লিটন, কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মামুন, কামাল হোসেন আজাদ ও ছাফানুল করিম ঘটনাস্থলে আসেন।
লিয়াকতের নির্দেশে তারা সিনহার গাড়ি তল্লাশি শুরু করেন। তারা দুই সিটের মাঝখান থেকে একটি পিস্তল এবং ড্যাশ বোর্ডে কিছু কাগজপত্র, ক্যামেরা, সিডির বাক্স ও ভিডিও করার সরঞ্জাম বের করেন।
র্যাবের অভিযোগপত্রে আরও জানা যায়, সেই সময় গাড়িতে কোনো ধরনের মাদক পাওয়া যায়নি এবং জোরালো লাইটের আলোয় আশপাশের লোকজন সেই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন।
পরিদর্শক লিয়াকতের ফোন পেয়ে ওসি প্রদীপ একটি মাইক্রোবাস এবং একটি পিকআপ ভ্যানে ফোর্সসহ দ্রুত ঘটনাস্থলে আসেন। এসেই লিয়াকতের সঙ্গে একান্ত আলাপ করেন ওসি প্রদীপ।
আলাপ সেরে রাস্তায় পড়ে থাকা মেজর সিনহার কাছে যান ওসি। সিনহা তখনও জীবিত, পানি চাচ্ছিলেন। এসময় সিনহাকে গালিগালাজ করে তার বুকের বাম দিকে জোরে লাথি মারেন প্রদীপ। একপর্যায়ে পায়ের জুতা দিয়ে সিনহার গলায় পাড়া দিয়ে ধরলে তার নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আরও কিছুক্ষণ সিনহার দেহ ঘটনাস্থলে ফেলে রাখে পুলিশ।
এরপর ওসি প্রদীপের সঙ্গে টেকনাফ থানা থেকে মাইক্রোবাসে আসা পুলিশ সদস্যরা আবারও সিনহার গাড়ি তল্লাশি করেন। এবার তারা মাদক পাওয়ার ঘোষণা দেন। এরপর ওসি প্রদীপের নির্দেশে পুলিশ সদস্যরা সিফাতকে বেঁধে চেকপোস্টের ভেতরে নিয়ে যান। পরবর্তীতে সিফাতের মুখে পানি ঢেলে ‘অবর্ণনীয় কায়দায়’ নির্যাতন করা হয়।
রাত ১০টার দিকে কয়েকজন পুলিশ সদস্য একটি স্থানীয় ছাড়পোকা গাড়ি থামায়। প্রায় ৪০ মিনিট পর সিনহাকে ওই গাড়িতে উঠিয়ে হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেসময় পুলিশের সঙ্গেও বেশ কয়েকটি গাড়ি ছিল। এগুলোর কোনোটিতেই সিনহাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়নি।
র্যাবের তদন্তে আরও জানানো হয়, ঘটনার পর মামলার সাক্ষী সেনাবাহিনীর রামু ক্যান্টনমেন্টের সার্জেন্ট আইয়ুব আলী ঘটনাস্থলে গেলে তার সঙ্গে পুলিশ দুর্ব্যবহার করে এবং ঘটনাস্থল থেকে তাড়িয়ে দেন।
এছাড়াও হত্যার ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে মেজর সিনহা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে পর পর তিনটি সাজানো ও বানোয়াট মামলা দায়ের করে পুলিশ। র্যাবের অভিযোগপত্রে বলা হয়, ওসি প্রদীপের বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা আর ইয়াবা বাণিজ্যের কথা জেনে যাওয়া প্রদীপ পরিকল্পিতভাবেই সিনহাকে হত্যা করেছিলেন।
র্যাবের তৎকালীন মুখপাত্র আশিক বিল্লাহ বলেছিলেন, সিনহা জুলাই মাসের মাঝামাঝি প্রদীপের বক্তব্য নিতে গেলে প্রদীপ সরাসরি হুমকি দিয়েছিল। প্রদীপের ধারণা ছিলো হুমকি দিলেই সিনহা কক্সবাজার ত্যাগ করবে। কিন্তু কক্সবাজার ত্যাগ না করায় সিনহাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।
আশিক বিল্লাহ আরও জানান, গুলি করার পর সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করতেই তাকে হাসপাতালে নিতে সময়ক্ষেপণ করা হয়েছিল।