বঙ্গনিউজবিডি ডেস্ক:মুনিয়ার বোন ও খালাত ভাই যখন গুলশানে পৌঁছান তখন মুনিয়ার ফ্ল্যাটটির তালা বন্ধ পাওয়া যায়। ওই বাসার তালাটি ছিল অটোলক যা ভেতর ও বাইরে থেকে চাবি দিয়ে খোলা যায়। সাধারণত এ ধরনের জাপানি তালার চারটি চাবি থাকে। মাস্টার কি (চাবি) থাকে বাসার দায়িত্বে থাকা ম্যানেজার বা অন্য কারোর কাছে। এই চাবিতেই ঘুরপাক খাচ্ছে মুনিয়া হত্যা না আত্মহত্যা এই রহস্য।
মুনিয়ার পরিবারের বরাত দিয়ে জানা যায়, ওইদিন বাসার দায়িত্বরতরা একটি চাবি দিয়ে তালা খোলার চেষ্টা করেন, কিন্তু তালাটি খুলতে পারেননি। পরবর্তীতে তালাটি ভাঙতে হয়। এত বিলাসবহুল একটি বাসার তালা কেন ভাঙতে হলো- তা নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। তাহলে মালিকপক্ষের কাছে থাকা চাবিটি কোথায় ছিল? তাছাড়া পুলিশের জব্দকৃত জিনিসপত্রের কোথাও চাবির কথা উল্লেখ ছিল না।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাসুদ সালাউদ্দিন মনে করেন, ‘এটা একটি হত্যাকাণ্ড। বাসার একটি চাবি আনভীরের কাছে থাকার কথা, যেহেতু সে নিয়মিত ওই বাসায় যাতায়াত করত। আর দুটি চাবি মুনিয়া বা দুটির একটি মুনিয়ার বোনের কাছে থাকার কথা। তাহলে বাকি চাবিটি কি কৌশলে খুনিদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছিল- তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, ‘পুলিশ বলছে, দুইদিন ধরে মুনিয়ার বাসায় আনভীরের যাতায়াত ছিল না। আনভীর ছাড়া তার পরিবারের অন্য কেউ তো হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে। আর এটা যদি বাসার মালিকপক্ষের দায়িত্বরত কারোর সাথে আপস করে হয়, তাহলে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ম্যানুপলেট করে গায়েব করা কোনো বিষয় নয়। এমনকি সিসি ক্যামেরা ফাঁকি দিয়ে কীভাবে বাসায় প্রবেশ করতে হয়, তার সবটুকুই ওদের জানা। আর এর আগে যাতায়াত ছিল আনভীরের।
মুনিয়ার বোনের করা মামলার এজাহার অনুসারে জানা যায়, আনভীরের মা ও পিয়াসা নামে এক নারী দুইবার মুনিয়াকে হত্যার হুমকি দিয়েছে। মুনিয়া মারা যাওয়ার আগেও বোনের কাছে হত্যার সম্ভাবনা নিয়ে বলে, ও (আনভীর) আমাকে না মারলেও ওর মা আমাকে হত্যা করতে পারে। মুনিয়ার মৃত্যুর পরও কেন তাদের জিজ্ঞাসাবাদ কিংবা আটক করা হলো না, তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র সমালোচনার ঝড় বইছে।
আইনজীবী মাসুদ সালাউদ্দিন দাবি করেন, এ মৃত্যুটি আনভীরের পরিবার পেশাদার খুনি দ্বারা ঘটিয়েছে। প্রত্যক্ষভাবে খুনোখুনিতে যাওয়ার মতো পরিবার বসুন্ধরা গ্রুপের কেউ নয়।
মুনিয়ার বোন নুসরাত ও খালাত ভাই ইকবাল জানান, যে কক্ষে মুনিয়ার লাশ পাওয়া যায়, তা পরিপাটি ছিল। পায়ের নিচে টেবিলটি সরানো হয়নি। তার পা বিছানার সাথে সংযুক্ত ছিল। তাকে মেঝেতে ফেলে হত্যা করে তারপর লাশ ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। সুরতহাল রিপোর্ট অনুসারে মুনিয়ার গলায় অর্ধচন্দ্রাকৃতির কালো দাগ ছিল।
আইন বিষয়ক বিখ্যাত লেখক রায় বাহাদুর জয়সিং পি, মোদির লেখা মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বইয়ে হত্যার আলামত ও আত্মহত্যার বিবরণে উল্লেখ করা হয়, যদি কেউ গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে তবে তার গলায় ইউ আকৃতির দাগ থাকবে। ওড়না পেঁচিয়ে হত্যা করা হলে দাগ হবে অর্ধচন্দ্রাকার বা গোলাকার। মুনিয়ার গলার দাগটি অর্ধচন্দ্রাকার। মুনিয়ার দুই হাতে গভীর কালো দাগ রয়েছে।
আইনজীবী মাসুদ সালাউদ্দিন বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের সময় পেশাদার খুনিরা আলামত নষ্ট করার জন্য তার দুই হাতে শক্ত কিছু বা যান্ত্রিক কোনো কিছু দিয়ে চেপে ধরেছে। এর ফলে রক্ত সরে গভীর কালো দাগের সৃষ্টি হয়েছে। নিয়মিত ডায়েরি মেনটেইন করলেও আত্মহত্যার সম্ভাবনা নিয়ে সে কোনো সুইসাইড নোট লেখেনিয় পরিবারের সদস্যরা এমনটা দাবি করেছেন। মুনিয়া বারবার বলেছে, বিপদ আসছে, তোমরা আমাকে বাঁচাও। যার বাঁচার আকুতি আছে, পরিবারের সদস্যদের যে ফোন করে দেখা করতে বলেছে, সে আত্মহত্যা করবে, এটা বিশ্বাস করছেন না বোন নুসরাত ও ভগ্নিপতি মিজানুর রহমান। কারণ, মৃত্যুর আগের দিন মুনিয়া ফোন করে তার বোনকে কুমিল্লার বাসায় থাকা বাংলা অনুবাদ করা কোরআন শরিফ ও আড়ং থেকে জামা নিয়ে যেতে বলেছে। ঘটনার দিন বিপদের আশঙ্কা করে স্ন্যাপচেটে বারবার বোনকে আকুতি জানিয়েছে। ১১টার কিছু পর সাত-আটটা মেসেজ দেন মুনিয়ার বোন নুসরাত। কিন্তু তার উত্তর পাওয়া যায়নি। এ সময়ের মধ্যে বিপদ হয়ে যায়। ডেথ সার্টিফিকেট অনুসারে দুপুর ১২টা ৫মিনিটের সময় মারা যায় মুনিয়া। স্বামী-স্ত্রীর মতো একসাথে বসবাস করে কেউ যদি প্রতারণা করে বিয়েতে অসম্মতি জানায়, ‘বাংলাদেশের আইন অনুসারে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হয়। মৃত্যুর পূর্বের আলামত, মুনিয়ার ডায়েরি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবি থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট, তা হলো মুনিয়ার সাথে আনভীরের স্বামী-স্ত্রীর মতো সম্পর্ক ছিল এবং আনভীর শেষে প্রতারণা করেছে। যেটা বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য। প্রশ্ন উঠেছে নিহতের যৌনাঙ্গে রক্তক্ষরণ নিয়ে।
কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. নাজমুল আলম চৌধুরী বলেন, লাশ অল্প সময় ঝুলে থাকলে যৌনাঙ্গে বীর্য বা বীর্যরস বের হয়। আর দীর্ঘক্ষণ ঝুলে থাকলে নরম অঙ্গ দিয়ে রক্তপাত ঘটার সম্ভাবনা থাকে।
গত ২৬ এপ্রিল গুলশানের একটি ফ্ল্যাটে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী মোনারাত জাহান মুনিয়ার লাশ পাওয়া যায়। এ নিয়ে ওইদিন রাতে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে মামলা দায়ের করেন মুনিয়ার বোন নুসরাত জাহান। ২৭ এপ্রিল ময়নাতদন্ত শেষে কুমিল্লার টমছমব্রিজ কবরস্থানে তারা মা-বাবার পাশে তাকে দাফন করা হয়।