বঙ্গনিউজবিডি ডেস্ক : পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন: (হে নবী) আমি তোমাকে সারা জগতের জন্য রহমত বানিয়ে পাঠিয়েছি। (সুরা আম্বিয়া, আয়াত ১০৭)
এই রহমতের নবীর প্রতি উম্মতের সবচেয়ে বড় হক হলো তাকে মন ও মনন দিয়ে ভালোবাসা। তার প্রতি ভালোবাসা যেন আর সব ভালোবাসার ঊর্ধ্বে হয়। এমনকি জান ও প্রাণের চেয়ে যেন তিনি প্রিয় হন। ভালোবাসা যেন এমন তীব্র হয়— আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর মামুলি আরামের জন্য হাজারবার জান কোরবান দিতে দ্বিধা না থাকে।
এই ভালোবাসা ঈমানের আলামত। খোদ আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না তার কাছে আমি তার পিতামাতার চেয়ে, সন্তানাদির চেয়ে এবং সমস্ত মানুষের চেয়ে প্রিয় না হবো। (বুখারি, হাদিস : ১৫)
মুমিনের জন্য ভালোবাসার মূল কেন্দ্র স্বয়ং আল্লাহ পাক, তারপর হজরত মুহাম্মদ (সা.)। আর বাকি দুনিয়ার যতো প্রেমময় মানুষ আছে, যতরকমের ভালোলাগার জিনিস আছে— সবকিছুর অবস্থান দ্বিতীয়তে।
এই থেকে বোঝা যায় আল্লাহর রাসুলকে ভালোবাসা আমাদের প্রত্যেকের জন্য ওয়াজিব। কেননা দুনিয়াতে ভালোবাসার যতো কিছু আছে তার সবই তার কারণে প্রেমময়।
পবিত্র কুরআনে তাই আল্লাহ পাক এরশাদ করেন, নবীর ওপর মুমিনদের জানের চেয়ে বেশি হক আছে। (সুরা আহজাব, আয়াত : ৬) অর্থাৎ যেই ব্যক্তি নিজের জান-মাল ও প্রবৃত্তির ওপর তার প্রতি ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিতে না পারবে, বোঝা যাবে তার ঈমানে ঘাটতি আছে।
একবার হজরত ওমর ফারুক (রা.) রাসুলকে (সা.) বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আপনি আমার কাছে সবকিছুর চেয়ে বেশি প্রিয়, কেবল আমার জান ছাড়া।’ রাসুল (সা.) বলেন, ‘না (একথা সত্য নয়), আল্লাহর কসম যার হাতে আমার প্রাণ, ওইসময় পর্যন্ত (সত্য) নয়, যতক্ষণ না কারও কাছে আমি তার জানের চেয়ে বেশি প্রিয় হবো।’
রাসুল (সা.)-এর মুখ থেকে এই কথা ওমর (রা.)-এর মনে বিদ্যুতের মতো স্পর্শ করল, এবং তার মন ওই সময়ই বদলে গেল। তিনি বললেন, ‘খোদার কসম, আপনি আপনি আমার জানের চেয়ে বেশি প্রিয়।’ রাসুল (সা.) বললেন, ওমর, এক্ষণে তোমার ঈমান পরিপূর্ণ হলো। (সহিহ বুখারি, হাদিস ৬৬৩২)
আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসার ফায়দা অফুরান। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় ফায়দা হলো— প্রেমিক মানুষ তার প্রেমাস্পদকে (রাসুলকে) খুশি করতে প্রতিনিয়ত জান কুরবান দিতে পারে, এভাবে রসুলের আনুগত্য সহজ হয়ে যায়।
দ্বিতীয় বড় ফায়দা হলো— প্রত্যেক প্রেমিকের জন্য রয়েছে সুসংবাদ, যেই সুসংবাদ স্বয়ং আল্লাহর রাসুল (সা.) দিয়ে গেছেন : মানুষের হাশর-নাশর তার সাথেই হবে যাকে সে ভালোবাসে।
হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, এক সাহাবি রাসুলের দরবারে এসে জিজ্ঞেস করেন— ‘কিয়ামত কবে?’ রাসুল (সা.) জানতে চাইলেন ‘তুমি এর জন্য কী কী প্রস্তুতি নিয়েছ?’, সাহাবি বললেন, ‘আমি অধিক পরিমাণে নামাজ রোজা জাকাত সদকা আদায় করে কোনো প্রস্তুতি তো নিতে পারিনি, কিন্তু আল্লাহ ও তার রাসুলের প্রতি আমার ভালোবাসা আছে।’ রাসুল (সা.) তখন বললেন, ‘তুমি তার সাথেই থাকবে যাকে তুমি ভালোবাসো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস ৬১৭১)
সাহাবি বলেন, এই সুসংবাদের পর আমি এত খুশি হয়েছি, ইসলাম গ্রহণের পর অন্যকিছুতে এত খুশি হইনি।
হজরত সফওয়ান বিন কুদামাহ (রা.) বলেন, আমি হিজরত করে আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর দরবারে হাজির হই। আমি আরজ করি— হে আল্লাহর রাসুল, আপনার হাত দিন, আমি বায়আত গ্রহণ করব।
আল্লাহর রাসুল (সা.) তার হস্ত মোবারক বাড়িয়ে দিলেন। আমি বললাম, হে রাসুল, আমি আপনাকে ভালোবাসি। তখন তিনি বললেন, ‘মানুষ যাকে ভালোবাসবে, তার সাথেই সে থাকবে।’
এরকম আরও একটি হাদিস আছে। এক সাহাবি রাসুলের দরবারে হাজির হয়ে বলেন— ‘হে নবী, আপনি আমার সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ। আপনাকে যখন মনে পড়ে, আমি সইতে পারি না, ছুটে আসি আপনার খেদমতে। যখন আমার ও আপনার মৃত্যুর পরের কথা মনে আসে, তখন আমি ভাবি আপনি নিশ্চয় জান্নাতে সর্বোচ্চ সম্মানে সুউচ্চ আসনে অবস্থান করবেন। আমি যদি জান্নাতে যাই, তাহলে আপনাকে কীভাবে দেখব?’
এসময় আল্লাহ তাআলা এই আয়াত নাজিল করেন— ‘যারা আল্লাহ ও তার রসুলের আনুগত্য করবে, তারা তাদের সাথে থাকবে নবী সিদ্দিক শহীদ ও নেককারদের মধ্যে আল্লাহ যাদেরকে পুরস্কৃত করেছেন, আর সাথী হিসাবে তারা কতই-না সুন্দর।’ (সুরা নিসা, আয়াত ৬৯) এরপর আল্লাহর রাসুল (সা.) ওই সাহাবিকে ডেকে এই আয়াত শোনান।
প্রকৃত ভালোবাসার প্রথম আলামত হলো প্রেমিক আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর কাজকে নিজের সবকাজের ওপর প্রাধান্য দিবে। তার পূর্ণ আনুগত্য করবে। সুন্নতের গুরুত্ব দিবে। নিজের কুপ্রবৃত্তি রসুলের বিধানের আলোকে দমন করবে।
একবার রাসুল (সা.) হজরত আনাসকে (রা.) উদ্দেশ্য করে বলেন— বেটা, তুমি যদি পারো তাহলে অবশ্যই এমনভাবে সকাল-সন্ধ্যা পার করবে যে, তোমার মনের মধ্যে কারও প্রতি ঘৃণাবোধ থাকবে না।
কেননা এটাই আমার পথে চলার নিয়ম। আর যে ব্যক্তি আমার পথকে উজ্জীবিত করে, সে (প্রকৃতপক্ষে) আমাকেই ভালোবাসে। আর যে আমাকে ভালোবাসে, জান্নাতে সে আমার সাথে থাকবে। (সুনানু তিরমিজি, হাদিস ২৮৯৪
এটাও ভালোবাসার লক্ষণ যে রাসুল (সা.)-এর জীবন ও আদর্শ নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা করা, তার সাথে সাক্ষাতের আশা রাখা, এবং উঠতে-বসতে দরুদ পাঠ করা।
আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর সাথে সম্পর্ক রাখেন এমন মানুষদের ভালোবাসাও তাকে ভালোবাসার আলামত। সাহাবায়ে কেরাম, আহলে বাইত, বিশেষ করে চার খলিফা, হজরত হাসান ও হুসাইন, মুমিনদের মা (রাসুলের স্ত্রীগণ), ও রাসুল (সা.)-এর মেয়েদের প্রতি অন্তরের অন্তস্তল থেকে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা রাখাও ঈমানি দায়িত্ব।
আল্লাহর রাসুল (সা.) নিজেই সাহাবিদের প্রতি ভালোবাসা রাখা ঈমানের আলামত ও শত্রুতা বা ঘৃণা রাখাকে মোনাফেকি বলেছেন।
হজরত হাসান ও হুসাইন (রা.) সম্পর্কে তিনি বলেন, ইয়া আল্লাহ, আমার এই দুইজনের প্রতি ভালোবাসা আছে, আপনিও তাদেরকে ভালোবাসুন।
হজরত আনাস (রা.) বলেন, আমি আল্লাহর রাসুলকে (সা.) দেখেছি লাউ পছন্দ করতে, তারপর থেকে আমারও লাউ ভালো লাগতে শুরু করে। এটাও ভালোবাসার আলামত যে, রসুলের সাথে সম্পর্কযুক্ত সবকিছুর প্রতি ভালোবাসা থাকা।
তিনি যেই শহর ভালোবাসতেন, তার জন্যে জান উৎসর্গ করার মন থাকা, তার প্রতিটি বালুকণার প্রতি ভালোবাসা রাখা— এই সবই পারতপক্ষে রাসুলকে ভালোবাসারই নিশানা।
রাসুল (সা.)-এর প্রত্যেক উম্মতের প্রতি ভালোবাসা থাকাও তাকে ভালোবাসার নিদর্শন। তার উম্মতের প্রতি আন্তরিকতা থাকা এবং তাদের সুপথে ডাকা।
মোদ্দাকথা, রাসুলকে (সা.) ভালোবাসা ঈমানের অংশ ও ঈমানদারের আলামত। এই ভালোবাসা হৃদয়ের গহীন থেকে উৎসারিত, কেবল লোকদেখানো ভালোবাসা নয়। যারা আল্লাহর রাসুলকে (সা.) ভালোবাসে, আল্লাহ তাদের সম্পর্কে কোরআনে ঘোষণা দেন— ‘তারা আল্লাহর দল, মনে রেখো, নিশ্চয় আল্লাহর দলের লোকেরাই সফল।’ (সুরা মুজাদালাহ, আয়াত ২২)
তো আমরা যদি প্রকৃতপক্ষেই ঈমানদার হতে চাই, ইহকাল ও পরকালে কামিয়াব হতে চাই, তাহলে আমাদের উচিৎ আল্লাহর রাসুল (সা.)কে জানা, এবং সব ভালোবাসার ঊর্ধ্বে তার ভালোবাসা প্রাধান্য দেওয়া— হাদিসে পাকে খোদ আল্লাহর রাসুল (সা.) যেভাবে নির্দেশ করেছেন। আল্লাহ আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুন।