বঙ্গনিউজবিডি ডেস্ক:জয়পুরহাট জেলা সদরের জামালপুরের পঞ্চাশোর্ধ্ব কৃষকরা ঋণ-দেনা করে নিজেদের উদ্যোগে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে স্ট্রবেরি চাষ করছেন। কম খরচে বেশি লাভ হয় স্ট্রবেরি চাষে। কৃষকদের এককালীন বিঘাপ্রতি এক থেকে দেড় লাখ টাকা খরচ করতে হয়, যা সাধারণ কৃষকদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে কেউই কৃষি বিভাগের কোনো প্রণোদনা পাননি বলে অভিযোগ করেন।
সরেজমিনে জামালপুর কালিবাড়ি-চাঁন্দা মাঠে দেখা যায়, স্ট্রবেরি খেত জাল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। আর জালের ভেতরে কেউ সবুজ গাছের স্ট্রবেরির পরিচর্যা করছেন, কেউ সেচ দিচ্ছেন, আবার কেউ কেউ বিক্রির জন্য লাল টকটকে স্ট্রবেরি ফল উত্তোলন করছেন।
স্ট্রবেরি-চাষিরা বলেন, ভাদ্র মাসের প্রথম দিকে শুরু করতে হয় স্ট্রবেরি চাষ। সে সময় জমি উর্বর করার জন্য পাওয়ার টিলার বা ট্রাক্টর দিয়ে কয়েকবার চাষ করে নিতে হয়। তারপর সার, গোবর ও ক্যালসিয়ামসহ অন্যান্য উপাদান ব্যবহার করে জমি প্রস্তুত করতে হয়। এরপর স্ট্রবেরির চারা রোপণ করার সময় হয়। ওই সময় একটি চারার দাম ১৫ থেকে ২০ টাকা থাকে। এক বিঘা জমিতে পাতলা করে চারা লাগালে ৪ থেকে ৫ হাজার চারা লাগে।
তারা আরও জানান, গাছে স্ট্রবেরি ফল আসতে শুরু করলে জমির চারদিক ও ওপরের অংশে জাল দিয়ে ঘিরে দিতে হয়। স্ট্রবেরি চাষের জন্য প্রতি বিঘা জমিতে সব মিলে এক থেকে দেড় লাখ টাকা হয়। এককালীন এত টাকা জোগাড় করতে মুশকিল হয়ে যায়। এ জন্য সার-হাল চাষে বাকি রাখা হয়। আবার অনেক কৃষক ঋণ করে এ ফসল চাষ করেন।
১৩ বছর ধরে স্ট্রবেরি চাষ করেন কৃষক আমজাদ হোসেন। তিনি বলেন, স্ট্রবেরি চাষে আমাদের এককালীন এক থেকে দেড় লাখ টাকার মতো খরচ হয়। পরে ফল উঠলে তা খরচ করে অন্যান্য ওষুধ কেনা হয়। কিন্তু এককালীন খরচ করতে আমরা হিমশিম খাই। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে আমাদের কোনো সহায়তা দেওয়া হয় না। কৃষি কর্মকর্তারা এসে ফসলের মাঠ ঘুরে চলে যান।
এক কৃষকের সফলতা দেখে ছয় বছর আগে দেড় বিঘা জমিতে স্ট্রবেরি চাষ শুরু করেন ইউনুস আলী। তিনি বলেন, প্রথমবার এ চাষে লাভবান হওয়ায় পরের বছর থেকে এখন পর্যন্ত দুই বিঘা জমিতে স্ট্রবেরি চাষ করছি। গত বছর স্ট্রবেরি চাষ এই এলাকায় ৭৩ জন কৃষক স্ট্রবেরি চাষ করেছিল। এ বছর নতুন করে আরও ৯ জন কৃষকসহ ৮২ জন স্ট্রবেরি চাষ করছেন।
তিনি আরও বলেন, আমি দুই বিঘা জমি থেকে এখন প্রতিদিন এক মণ করে স্ট্রবেরি ফল উত্তোলন করছি। আরও কয়েক দিন পর এর পরিমাণ বেড়ে যাবে। প্রথমের দিকে ৪৫০ টাকা কেজি থাকলেও বর্তমান বাজারে ৩৫০ টাকা স্ট্রবেরির কেজি। এক মাস ধরে স্ট্রবেরি তোলা যাবে। এতে বিঘাপ্রতি সাড়ে ৩ থেকে ৪ টাকা বিক্রি সম্ভব।
সাখাওয়াত হোসেন নামের এক কৃষক বলেন, আমি চার-পাঁচ বছর ধরে স্ট্রবেরি চাষ করছি। এ ফসল অত্যন্ত লাভজনক হলেও আমরা তেমন লাভবান হতে পারি না। কারণ লাভের মূল অংশ হচ্ছে বাজার জাতকরণ। দূর-দূরান্তের ক্রেতারা এসে নিয়ে যায়। আমরা অন্যের মুখে সত-আটশ টাকা কেজি শুনলেও ক্রেতারা তিন থেকে সাড়ে চারশ টাকা দেয়। তারা যা বলে আমরা বোকার মতো সেই টাকায় নিই। তাই এই এলাকায় সরকারকে স্থানীয়ভাবে বাজারের মাধ্যমে স্ট্রবেরি ক্রয়-বিক্রয়ের পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান এই চাষি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষকদের সহায়তা হিসেবে ২০২১-২২ ফসল চাষ মৌসুমে কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় তিন কোটির অধিক টাকা বরাদ্দ ধরা হয়েছে। আলু, গম, ভুট্টা, পেঁয়াজ, সরিষা, মুগ ডাল, মসুর ডাল, কন্দাল, মাষকলাই, পাটবীজ উৎপাদন, রোপা আমন, বোরো উপশী, হাইব্রিড, সমলয় পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষাবাদসহ অন্যান্য ফসলের সঙ্গে জড়িত ৪১ হাজারের অধিক চাষির প্রণোদনার বরাদ্দ থাকলেও স্ট্রবেরি চাষে কোনো প্রণোদনার বরাদ্দ নেই।
জয়পুরহাট সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. কায়ছার ইকবাল বলেন, জয়পুরহাট সদর উপজেলায় এবার প্রায় আট হেক্টর জমিতে স্ট্রবেরি চাষ হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে দুই হেক্টর বেড়েছে। এই চাষের পুরো কৃতিত্বই কৃষকদের। কারণ, তারা স্বপ্রণোদিতভাবে স্ট্রবেরি চাষ করছেন। কৃষি বিভাগের প্রণোদনা না পেলেও উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকদের পরামর্শ দেওয়ার জন্য মাঠে যান।
জেলা বাজার পরিদর্শক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে কৃষকদের জন্য স্থানীয়ভাবে কোনো বাজারে স্ট্রবেরি বিক্রির কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তবে ওই এলাকায় কৃষকরা চাইলে তাদের এবং ঢাকার ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এই উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, অন্যান্য ফসল চাষে কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়া হলেও স্ট্রবেরি চাষে প্রণোদনা দেওয়া হয় না। সরকারিভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তাদের প্রণোদনার আওতায় আনা হবে।