বঙ্গনিউজবিডি ডেস্ক: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) আন্দোলনরত শিক্ষার্থীর নিজেদের দাবি নিয়ে আলোচনার জন্য শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ক্যাম্পাসে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
শুক্রবার (২৮ জানুয়ারি) বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে তারা শিক্ষামন্ত্রীকে ক্যাম্পাসে আমন্ত্রণ জানানোর পাশাপাশি উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগসহ তাদের সব দাবি দ্রুত মেনে নেয়ার আহ্বান জাানান।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে মোহাইমিনুল বাশার রাজ বলেন, ‘পুলিশি হামলায় আহত এবং অনশনরত অবস্থায় অসুস্থ শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার সব খরচ প্রধানমন্ত্রী বহন করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। ইতোমধ্যে অসুস্থ একজনকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের নির্দেশনায় শিক্ষামন্ত্রী আমাদের সব দাবি পূরণের আশ্বাস দিয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে আমাদের দাবি ও বিভিন্ন সমস্যা প্রসঙ্গে আলোচনার জন্য শাবিতে আসার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন আমরাও আমাদের দাবি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি। তার সামনে উপস্থাপনের জন্য ইতোমধ্যে বেশ কিছু সমস্যা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে।’
শিক্ষামন্ত্রী দ্রুতই ক্যাম্পাসে আসবেন এমন আশা করে আন্দোলনর শিক্ষার্থীদের মুখপাত্র বলেন, ‘তিনি দ্রুতই ক্যাম্পাসে এসে আমাদের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেবেন। একই সঙ্গে আমরা এও আশা করছি যে, আমাদের মূল দাবিসহ অন্যান্য বিষয়ে যেসব আশ্বাস দেয়া হয়েছে, সেগুলোও দ্রুত পূরণ করা হবে।’
সংবাদ সম্মেলনে শাবি উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের আগ পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা শিক্ষার্থীরা পুনর্ব্যক্ত করেন।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের শুরু হয় ১৩ জানুয়ারি। ওই দিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন হলের কয়েক শ ছাত্রী। ছাত্রীদের অভিযোগ, সিরাজুন্নেসা হলের ছাত্রীরা কিছু সমস্যার কথা বলতে প্রাধ্যক্ষ জাফরিন লিজাকে মোবাইল ফোনে কল করেন। এ সময় তিনি ছাত্রীদের সঙ্গে অসদাচরণ করেন। এর প্রতিবাদে ছাত্রীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে হলের সামনে বিক্ষোভ শুরু করলে ছাত্রলীগ ছাত্রীদের আন্দোলনে হামলা চালায়।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেছেন, আবাসিক হলের পানি, সিট, ইন্টারনেট, খাবারসহ বেশ কিছু সমস্যা নিয়ে শিক্ষার্থীরা হলের রিডিং রুমে আলোচনা করছিলেন। আলোচনার মাঝে হল প্রভোস্ট অধ্যাপক জাফরিন আহমেদ লিজাকে ফোন দিয়ে অল্প সময়ের জন্য হলে আসার জন্য অনুরোধ করা হয়। প্রথমে তিনি অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে যেতে চান। এরপর শিক্ষার্থীরা তাঁর কাছে প্রভোস্ট বডির কাউকে হলে পাঠানোর অনুরোধ জানালে জাফরিন আহমেদ লিজা ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ‘কেউ তো মরেনি যে তোমাদের দেখতে আসব। আমার এত ঠেকা পড়েনি। ইচ্ছে হলে থাক, নয় তো বেরিয়ে যেতে পারো!’
প্রভোস্টের এ মন্তব্যে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন শিক্ষার্থীরা। তারা বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন শুরু করলে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা সেখানে হামলা চালান। আন্দোলনরত ছাত্রীরা জানান, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা এসে কর্মসূচি গুটিয়ে তাদের চলে যেতে বলেন। এ সময় আন্দোলনকারী ছাত্রীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের বাগ্বিতন্ডা হয়। এরই মধ্যে ছাত্রীদের আন্দোলনে সংহতি জানাতে যাওয়া ১০-১২ জন শিক্ষার্থীকে সেখানে বেধড়ক মারধর করা হয়। হামলাকারীদের হাত থেকে তাদের বাঁচাতে গিয়ে হেনস্তার শিকার হন আন্দোলনরত কয়েকজন ছাত্রী। ক্যাম্পাসের গোলচত্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক জহির উদ্দিন আহমেদ এবং প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক ড. আলমগীর কবিরের উপস্থিতিতে এ ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনার পর ‘শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের হামলা কেন, প্রশাসন জবাব চাই’সহ বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে ছাত্রীরা হামলার বিচার ও প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদের পদত্যাগ দাবিতে তাদের কর্মসূচি চালিয়ে যেতে থাকেন। আন্দোলনের একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি ভবনে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করেন। তখন শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা ও তাদের লক্ষ্য করে শটগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে পুলিশ। এতে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন। পুলিশ ৩০০ জনকে অজ্ঞাত দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা করে। পরে ১৫ জানুয়ারি রাতে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ও শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেন কর্তৃপক্ষ। এতে আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন শিক্ষার্থীরা। এবার তারা উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। এরই মধ্যে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদ লিজা পদত্যাগ করলেও শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ দাবিতে ১৯ জানুয়ারি বিকালে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে ২৪ শিক্ষার্থী আমরণ অনশনে বসেন। পরে তাদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে বাড়তে থাকে অনশনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে তৈরি হওয়া অচলাবস্থা নিরসনে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ২২ জানুয়ারি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরদিন তিনি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও ভার্চুয়ালি বৈঠকে অংশ নেন। কিন্তু কোনো সমাধানে পৌঁছতে পারেননি। অব্যাহত থাক শিক্ষার্থীদের অনশন। অনশনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীর অনেকেই অসুস্থ হন। আন্দোলনরত কয়েক শ শিক্ষার্থী ‘সম্মিলিত অনুরোধ’ জানিয়ে অনশনরত শিক্ষার্থীদের অনশন থেকে সরে আসার অনুরোধ জানালেও তাঁরা সে আহ্বানও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তবে অনশন শুরুর ১৬৩ ঘণ্টা ২০ মিনিট পর বুধবার সকাল ১০টা ২০ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল শিক্ষার্থীদের পানি পান করিয়ে অনশন ভাঙান।