খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ২৪ মে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং মেয়াদ ও সেমিস্টার ভিত্তিক ক্রেডিট ঘণ্টা কমাতে ৫ সদস্যের একটি কমিটি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কমিটিতে কারিগরি অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে সভাপতি করে একজন অতিরিক্ত সচিব, কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের কারিকুলাম পরিচালক, অধ্যক্ষ ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং ডিপ্লোমা কারিকুলাম বিশেষজ্ঞকে রাখা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ ও কমিটির সদস্য সচিব কাজি জাকির হোসেন বলেন, ‘এটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেখছে, বিষয়টি আমার জানা নেই।’
৫ সদস্যের কমিটিতে আপনিও আছেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটি লুকানোর কিছু নেই। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কমিটি কোনো কাজ করেনি।’
চার বছরের কোর্স ৩ বছরে, শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
সূত্র জানায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশে ডিগ্রী ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ৩ বছরে কোর্স শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে ইউএনডিপি’র একটি জরিপে দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী ডিপ্লোমা কোর্সের সঙ্গে বাংলাদেশের ৩ বছর মেয়াদী কোর্সের কারিকুলামে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। এসব কারণে কোর্সে নতুন নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করে সংস্থাটি। এরপরও কারিকুলামে ঘাটতি থাকায় ভারত, শ্রীলংকা ও পাকিস্থানের প্রকৌশলীরা যে বেতন পাচ্ছেন তাদের থেকে বাংলাদেশি ডিপ্লোমাধারীরা কম বেতন পান। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ২০০১ সাল থেকে ৩ বছরের কোর্সকে ৪ বছরে উন্নীত করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করে বলেন, পৃথিবীতে যখন চতুর্থ শিল্প বিল্পব শুরু হয়েছে তখন ২০ বছর পর এসে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আবারো চার বছর কোর্সকে তিন বছর করার পাঁয়তারা শুরু করেছেন। সরকার কর্মমুখী শিক্ষার প্রসারে যে কাজ শুরু করেছে এমন সিদ্ধান্ত তার পরিপন্থী। ৪ বছরের কোর্স ৩ বছর করা হলে ক্ষতিগ্রস্থ হবে ডিপ্লোমা শিক্ষা ব্যবস্থা। স্কুলিং বছর কমে গেলে আন্তর্জাতিকভাবেও প্রশ্নবিদ্ধ হবে ডিপ্লোমা প্রকৌশল শিক্ষা।
জানা যায়, বাংলাদেশের ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা এখন উপ-সহকারি প্রকৌশলী হিসেবে ১০ গ্রেডে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন। ৩৫ বছরের আন্দোলনের ফলে এটি করা হয়েছে।
ডিপ্লোমা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে নতুন সংকটে পড়েছে। দেশের ৪৯টি পলিটেকনিক ইনিস্টিটিউট এবং ৬৪টি টিটিসিতে ক্লাসরুম, ল্যাব, ওয়ার্কসপ, ব্যবহারিক যন্ত্রপাতির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়াও রয়েছে শিক্ষক স্বল্পতা।
এ বিষয়ে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পরিচালক (কারিকুলাম) ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোর্স কমানোর কথা আমাদেরকে বলেনি। ক্রেডিট ঘণ্টা কমিয়ে পর্যালোচনা করতে বলা হয়েছে। বিষয়টির যাচাই-বাছাই কোভিডের কারণে শুরু হয়নি। তিনি আরো বলেন, স্টেক হোল্ডারদের নিয়ে আলোচনা করতে হবে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ক্লাস থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শুরু হলেও গড়ে শিক্ষার্থীকে ১৪ বছরের স্কুলিং করা হয়। শ্রীলংকাতে ৩ বছরের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং হলেও কোর্সটিতে শিক্ষার্থীরা অংশ নেয় ১১ ক্লাস থেকে। চীনে ১৫ বছরে স্কুলিং করা হয়। সিঙ্গাপুরে ৪ বছর মেয়াদী এ কোর্স ১০ম ক্লাস থেকে এ কোর্স শুরু হয়।
জাপানে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স ৫ বছরের। আইডিইবি আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক কামরুজ্জামান নয়ন বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাদ্রাসা ও কারিগরি বিভাগের আমলাতন্ত্রের কারণে আমাদের ডিপ্লোমা প্রকৌশল সিলেবাসের আধুনিকায়ন হচ্ছেনা। এর ফলে আমরা আন্তর্জাতিক মান অর্জন করতে পারছি না। বাংলাদেশে ১০ম ক্লাশের পর চার বছরের এ কোর্সের ফলে শিক্ষার্থীরা ১৪ বছরের স্কুলিং করে। এটিকে যদি তিন বছরের করা হয় তবে মোট স্কুলিং হবে ১৩ বছর। যা ভবিষ্যতে তাদের চাকরির বাজারে সমস্যা তৈরি করবে।
ইন্সটিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইডিইবি) কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মো. শামসুর রহমান বলেন, বিশ্বব্যাপী সব ধরণের শিক্ষা কারিকুলাম সিলেবাসে পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশে পরিবর্তন হয়না। যেখানে পৃথিবীর অন্যান্য ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউটে বছর বছর সিলেবাস বাড়িয়ে যুগোপোযোগী ও আধুনিকায়ন করা হচ্ছে সেখানে আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় নির্বিকার।
তিনি আরো বলেন, ডিপ্লোমা কলেজগুলোতে ৭০ ভাগ শিক্ষকের পদ খালি। শ্রেণিকক্ষে যুগোপযোগী ল্যাব ব্যবস্থা নেই। অথচ পাকিস্থান আমলে ঢাকা পলিটেকনিকে ৩৬০ জন শিক্ষার্থীর জন্য যে কেমিস্ট্রি ল্যাব ছিলো এখন সাড়ে ১০ হাজার শিক্ষার্থী একই ল্যাব ব্যবহার করছেন। এসব পরিবর্তন না করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পলিটেকনিক শিক্ষাকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান বলেন, বিশ্বের প্রথম সারির ইনস্টিটিউটে প্রতিবছর সিলেবাস পরিবর্তন হয়। শুধুমাত্র আমাদের দেশেই এটি সেভাবে করা হয়না। এখন চার বছরের কোর্স তিন বছর করা হলে অবশ্যই সেটি চাকরির বাজারে প্রভাব ফেলবে। তবে আমাদের দেশে যেসব কোর্স এখন রয়েছে সেটি তিন বছরে পড়ানো সম্ভব। তবে হঠাৎ করে ৪ বছর মেয়াদি কোর্সকে তিনবছর করা হলে নতুন করে জটিলতা দেখা দেবে। এজন্য সিলেবাস পরিবর্তন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত বা পরিকল্পনা নেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, কমিটির কোনো কার্যক্রম হয়নি। এমনকি আমরা চিঠিও পাইনি।-বাংলাদেশ জার্নাল