বঙ্গনিউজবিডি ডেস্ক: ব্যাংকের মতোই গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ ও ঋণও দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখছে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (এনবিএফআই)। বেশির ভাগ এনবিএফআইয়ের প্রধান ব্যবসা লিজিং বা ইজারা দেওয়া। এ ছাড়া মেয়াদি ঋণ, হাউজিং ফাইন্যান্স, মার্চেন্ট ব্যাংকিং, ইকুইটি ফাইন্যান্সিং ও ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফাইন্যান্সিংয়ে বৈচিত্র্য আনছে এনবিএফআইগুলো। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে এনবিএফআইগুলো আরো বড় ভূমিকা রাখার সক্ষমতা রাখে।
এ জন্য এনবিএফআইগুলোতে সুশাসন নিশ্চিত করা, তদারকি বাড়ানো, তারল্যের জোগান, উদ্ভাবনী ও বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্যের মাধ্যমে গ্রামমুখী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, মহামারির মধ্যে ২০২১ সালে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত কিছুটা কমেছে। গত এক বছরের ব্যবধানে দেশের এনবিএফআইগুলোর সংগৃহীত আমানত ১.৪৬ শতাংশ কমেছে। গত ডিসেম্বর শেষে এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪২ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। এর আগের বছর, অর্থাৎ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে এনবিএফআইগুলোর সংগৃহীত আমানতের পরিমাণ ছিল ৪৩ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা।
তবে আলোচিত এক বছরে এনবিএফআইগুলোর বিতরণ করা ঋণ বেড়েছে শূন্য দশমিক ৮৯ শতাংশ। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিতরণ করা ঋণ সুবিধার স্থিতি ছিল ৬৬ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা। ২০২১ সালের ডিসেম্বর ঋণের স্থিতি বেড়ে ৬৭ হাজার ১৬২ কোটি টাকায় উঠে আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, এনবিএফআইগুলোর সংগৃহীত আমানতের ৯২.০৯ শতাংশই ঢাকা বিভাগের ভেতরের শাখাগুলোতে রয়েছে। এর পরেই চট্টগ্রামে আছে ৪.৮৮ শতাংশ।
এ ছাড়া বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে বেসরকারি খাতের ঋণ ছিল ৬৬ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা। আর সরকারি ঋণ ৩১৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বেসরকারি ঋণ ছিল ৬৬ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা। আর সরকারি ঋণ ছিল ৪০৪ কোটি টাকা।
সবচেয়ে বেশি ঋণ গেছে শিল্প খাতে, প্রায় ৪০ শতাংশ। ব্যবসা ও বাণিজ্য খাতে ২২ শতাংশ, ভোক্তাঋণ ১৬ শতাংশ, নির্মাণ খাতে ১৪ শতাংশ, কৃষিতে ১ শতাংশ, যোগাযোগ খাতে ২ শতাংশ এবং অন্যান্য খাতে বাকি ৫ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।
আমানতের মতো ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে শীর্ষ অবস্থানে আছে ঢাকা বিভাগ। ৮৪ শতাংশ ঋণই ঢাকা বিভাগের ভেতরের শাখাগুলোতে রয়েছে। এর পরেই চট্টগ্রামে ১০ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, আগে অনেক ঋণের সুদের হার ১৬-১৭ শতাংশ ছিল। ব্যাংকের ঋণের সুদ ৯ শতাংশ নির্দিষ্ট করে দেওয়ার পর আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের সুদও কমেছে। বেশির ভাগ শাখা শহরাঞ্চলে, সারা দেশে এনবিএফআইগুলোর শাখা রয়েছে ২৯৬টি। এর মধ্যে শহরাঞ্চলে ২৭২ এবং গ্রামাঞ্চলে ২৪টি শাখা রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি সরকারি এনবিএফআইয়ের শাখা রয়েছে ৫৭টি। বেসরকারি ৩১টি এনবিএফআইয়ের শাখা রয়েছে ২৩৯টি। বিভাগের হিসেবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঢাকায় ১৬৯টি, চট্টগ্রামে ৪৫টি, খুলনায় ১৫টি, রাজশাহীতে ১৯টি, বরিশালে পাঁচটি, সিলেটে ১৯টি, রংপুরে পাঁচটি ও ময়মনসিংহে ১৯টি শাখা রয়েছে
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে এখন ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পাঁচ থেকে সাতটি অনিয়মের কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছে। বাকিগুলো বেশ ভালো আছে, কিন্তু দুর্বলগুলোর কারণে পুরো খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এই ধাক্কা সামলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্ধার করতে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ কাঠামো জোরদার করেছে। অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। একই সঙ্গে নীতি কাঠামোতে দেওয়া হয়েছে ব্যাপক ছাড়, যাতে দুর্বলতা কাটিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো উঠে দাঁড়াতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, আর্থিক খাতে তদারকি জোরদার করা হয়েছে। দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোকে সবল করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যেসব অনিয়ম হয়েছে সেগুলোর বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, দেশের ব্যাংকগুলো স্বল্পমেয়াদি আমানত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করছে। সে জন্য ব্যাংক খাতে বড় ধরনের অসামঞ্জস্য তৈরি হয়েছে। এ অসামঞ্জস্য দূর করতেই জন্ম হয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের।
ফজলে কবির আরো বলেন, কিন্তু সমস্যা হলো, এনবিএফআইগুলোও তিন মাস মেয়াদি আমানত নিচ্ছে। তিন মাস মেয়াদি আমানত দিয়ে যদি ১০-১২ বছরের জন্য ঋণ দেওয়া হয়, তাহলে সংকট থেকেই যাবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এনবিএফআইগুলোকে অনেক বেশি বিশেষায়িত হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
তহবিল সংকট : আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট তহবিলের ৮৪ শতাংশই আসে ব্যাংক থেকে। বাকি ১৬ শতাংশ সঞ্চয়ীদের আমানত ও অন্যান্য উৎস থেকে আসে। অর্থাৎ তহবিলের জন্য তাদের ব্যাংকের ওপরই ভরসা করতে হচ্ছে। লিজিং কম্পানিগুলো ব্যাংক থেকে স্থায়ী আমানত, মেয়াদি আমানত ও কলমানির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করত। দুই বছর ধরে বেশ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে নেওয়া আমানত ও কলমানিতে নেওয়া ধার সময়মতো পরিশোধ করতে পারছিল না। পরে বাধ্য হয়ে দফায় দফায় এগুলোর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। তার পরও তা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। এমন পরিস্থিতিতে ১০ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) চেয়ারম্যান, আইপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোমিনুল ইসলাম বলেন, দু-চারটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানেরই তারল্য সংকট রয়েছে। সেই জায়গায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা রাখতে হবে। খুব বেশি নয়, যদি এই খাতে ১০ হাজার কোটি টাকার একটি লোন দেওয়া হয়, তাহলে এই খাত আরো চাঙ্গা হবে এবং অর্থনীতি বিকাশের জন্য দেশের বেসরকারি খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্স লিমিটেডের এমডি ও সিইও মো. কায়সার হামিদ বলেন, শেষ কয়েক বছরে কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এ খাতে কিছুটা নেতিবাচকতা তৈরি করেছিল; যদিও তা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলছে এবং উতরে যাওয়ার পথেও চলে এসেছে। আসছে বাজেটে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য বিভিন্ন উৎস থেকে তহবিল ব্যবস্থাপনা, খেলাপি ঋণ আদায়ে অধিকতর তৎপরতা, প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যোগ্যতাসম্পন্ন মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ থাকলে এই খাতকে সমৃদ্ধ হতে সহায়তা করবে।
ঋণের সুদহার ১২ শতাংশ করতে চান এনবিএফআই নেতারা : মূল্যস্ফীতির চাপে আমানতের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় ঋণের সুদহার বাড়িয়ে ১২ শতাংশ করার অনুমোদন চেয়েছেন ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নেতারা। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গে বৈঠকে তাঁরা এ প্রস্তাব দেন।
মো. মোমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমান সুদহারে আমানত পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করে ঋণ সুদহার ১২ শতাংশ পর্যন্ত নেওয়ার অনুমোদন চেয়েছি। তিনি আমাদের কথা শুনেছেন, যাচাই-বাছাই করে বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন। ’
গত ১৮ এপ্রিল ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুদের হারে সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দিয়ে আমানতে ৭ শতাংশ এবং ঋণে সর্বোচ্চ ১১ শতাংশ বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন এ হার কার্যকর হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বেলায় প্রথমবারের মতো সুদহার বেঁধে দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, নতুন নেওয়া আমানত ও ঋণের ক্ষেত্রে এ নির্দেশনা মানতে হবে।