বঙ্গনিউজবিডি ডেস্ক : রাষ্ট্রীয় গোপন নথি চুরির অভিযোগে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। মামলা নং-১৬। সোমবার (১৭ মে) রাতে শাহবাগ থানায় মামলাটি করেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ডা. মো. শিব্বির আহমেদ ওসমানী। এই মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে ডিএমপির রমনা জোনের অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অভিযোগের ভিত্তিতে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের উপসচিব ডা. মো. শিব্বির আহমেদ ওসমানী। মামলার একমাত্র আসামি রোজিনা ইসলাম। মামলা হয়েছে দণ্ডবিধি ৩৬৯, ৪১১ ধারায় ও অফিসিয়ালস সিক্রেসি অ্যাক্ট ৩ ও ৫ ধারায়।
মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেছেন, সোমবার বিকেল ২ টা ৫৫ মিনিটে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবের একান্ত সচিবের দপ্তরে রোজিনা ইসলাম নামীয় একজন নারী প্রবেশ করেন। এ সময় একান্ত সচিব দাপ্তরিক কাজে সচিবের কক্ষে অবস্থান করছিলেন। উক্ত নারী দাপ্তরিক গুরুত্বপূর্ণ কাগজ-পত্র শরীরের বিভিন্ন স্থানে লুকোনো এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ছবি তোলেন। এ সময় সচিবের দপ্তরে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য মো. মিজানুর রহমান খান দেখতে পান এবং তাকে বাধা প্রদান করেন এবং তিনি নির্ধারিত কর্মকর্তার অনুপস্থিতিতে কক্ষে কি করছেন মর্মে জানতে চান। এ সময় তিনি নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় প্রদান করেন। পরবর্তীতে অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেছা বেগম, উপসচিব জাকিয়া পারভীন, সিনিয়র সহকারী সচিব শারমীন সুলতানা, সচিবের একান্ত সচিব মো. সাইফুল ইসলাম ভূঞা, সিনিয়র সহকারী সচিব মোসাদ্দেক মেহদী ইমাম, অফিস সহায়ক মো. মাহফুজুল ইসলাম, সোহরাব হোসেনসহ অন্যান্য কর্মকর্তা ও স্টাফগণ ঘটনাস্থলে আসেন এবং অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেছা বেগম তল্লাশি করে তার কাছ থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র এবং ডকুমেন্টসের ছবি সম্বলিত মোবাইল উদ্ধার করেন।
এতে প্রতীয়মান হয় যে, ডকুমেন্টসগুলো তিনি চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিলেন।এ সময় সচিবালয়ের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ কর্মকর্তার নেতৃত্বে শাহবাগ থানার মহিলা পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে তাকে জিম্মায় নেন।
এজাহারে আরো উল্লেখ করা হয়, বর্তমানে বিভিন্ন দেশের সাথে বাংলাদেশের ভ্যাকসিন ক্রয়/সংগ্রহ সংক্রান্ত নেগোসিয়েশন চলমান রয়েছে এবং খসড়া সমঝোতা স্মারক ও নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট প্রণয়ন কাজ চলমান রয়েছে। সমঝোতা স্মারক নিয়ে পক্ষদ্বয়ের মাঝে প্রতিনিয়ত পত্র এবং ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ হচ্ছে, যেখানে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সন্নিবেশিত রয়েছে। উক্ত নারী যেসকল নথিপত্রের ছবি তুলছিলেন তার মধ্যে উল্লিখিত গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রও ছিলো। এসকল তথ্য জনসমক্ষে প্রচার হলে সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়ার অশঙ্কা রয়েছে। উল্লিখিত কাগজপত্রসমূহ গুরুত্বপূর্ণ বিধায় মন্ত্রণালয়ে সংরক্ষিত আছে, যা পরবর্তীতে বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রদর্শন করা হবে।
এর আগে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিবের একান্ত সচিব মো. সাইফুল ইসলাম ভূঞার কক্ষে প্রায় সাড়ে ৫ ঘণ্টা আটক রাখার পর সোমবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে তাকে শাহবাগ থানায় নিয়ে যায় পুলিশ।
প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ শাহবাগ থানায় বলেন, রোজিনা বেশ কিছুদিন ধরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা নিয়ে বেশ কিছু আলোচিত রিপোর্ট করেছেন, নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট করেছেন। এই সমস্ত রিপোর্টের কারণে, আমাদের ব্যক্তিগত ধারণা, তিনি এসব রিপোর্টের কারণে আক্রোশের শিকার হয়েছেন, অন্যরা আক্রোশের বশবর্তী হয়ে এ কাজটি করেছে।
সচিবালয়ে কর্মরত সাংবাদিকরা সোমবার বিকালে রোজিনা ইসলামকে আটকে রাখার খবর পেয়ে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগে ছুটে যান। যে কক্ষে তাকে রাখা হয়েছিল, ছয়জন নারী পুলিশ সদস্যকে সেখানে দেখা যায়। কক্ষের বাইরে আরো কয়েকজন পুলিশ সদস্য ছিলেন। আসলে কী ঘটেছে জানতে উপস্থিত সাংবাদিকরা কয়েক দফা সচিব লোকমান হোসেন মিয়ার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন, কিন্তু তিনি কথা বলতে চাননি।
বেলা সাড়ে ৪টার দিকে রোজিনা ইসলাম বলেন, সচিবের সাথে দেখা করতে আমি তার একান্ত সচিব সাইফুলের কক্ষে আসি। এরপর হঠাৎ করে পুলিশ ডেকে এনে আমাকে এই কক্ষে আটক করা হয়।
আটকের পর দেহ তল্লাশি করা হয়েছে জানিয়ে এই সাংবাদিক বলেন, মিজান নামে এক পুলিশ সদস্য আমাকে নাজেহাল করেছে। এ দপ্তর থেকে কোনো ধরনের নথি আমি নিইনি।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে রোজিনা অসুস্থ হয়ে পড়লে সচিবালয়ে কর্মরত সাংবাদিকরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার দাবি তোলেন। তবে কর্মকর্তারা তাতে সাড়া দেননি।
রাত সোয়া ৮টার দিকে পুলিশের কয়েকটি গাড়ি সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের (৩ নম্বর ভবন) নিচে এনে রাখা হয়। এরপর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চতুর্থ তলা থেকে রোজিনা ইসলামকে লিফটে করে নিচে নামিয়ে একটি সাদা রঙের গাড়িতে তুলে থানার দিকে রওনা হয় পুলিশ। রোজিনাকে কী অভিযোগে আটক করা হল- তা সাংবাদিকরা জানতে চাইলে উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তারা কোনো উত্তর দেননি।
উপস্থিত সাংবাদিকরা এরপর আবারও সচিব লোকমান হোসেন মিয়ার সাথে দেখা করতে যান অভিযোগের বিষয়ে জানতে। তখনও তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
পরে রাত ৯টার দিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. মাইদুল ইসলাম প্রধান সাংবাদিকদের সামনে অভিযোগের বিষয়গুলো তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, রোজিনা কাগজপত্র সরানোর সময় একজন অতিরিক্ত সচিব, পুলিশের একজন সদস্য দেখে তাকে চ্যালেঞ্জ করে বলেন, এটা তিনি নিয়ে যেতে পারেন না। তখন পুলিশকে জানানোর পর মহিলা পুলিশ আসে। এখন তাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
রোজিনাকে শাহবাগ থানায় নেওয়ার পর তাকে ওসির কক্ষে রাখা হয়। অন্য সাংবাদিকদের সেখানে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
উপ কমিশনার সাজ্জাদুর রহমান রাত পৌনে ১০টার দিকে বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সাংবাদিক রোজিনাকে আমাদের হাতে সোপর্দ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, তারা অভিযোগ দিচ্ছে।
এদিকে রোজিনাকে শাহবাগ থানায় নেওয়ার কিছুক্ষণ পর উপস্থিত সাংবাদিকরা বাইরে বসে বিক্ষোভ শুরু করেন।
রাত ১০টার দিকে শাহবাগ থানার ওসির কক্ষ থেকে বেরিয়ে রোজিনার ছোট বোন সাবিনা পারভীন সুমী বলেন, ও অসুস্থ। ওর শরীর ভালো না। গায়ে জ্বর। সকালে টিকা নিয়েছে। ওর শারীরিক অবস্থা নিয়ে আমরা শঙ্কিত।
সচিবালয়ে কী ঘটেছে জানতে চাইলে সাবিনা বলেন, সোর্সের কাছ থেকে ও কিছু ডকুমেন্ট পায়। এরপর স্বাস্থ্য সচিবের রুমে যাবে, সেজন্য কনস্টেবল মিজানকে বলে। উনি বলছে যে, ‘কেউ নাই, আপনি ভেতরে বসেন’। তখন আপু বলে যে, ‘না আমি বসব না। আমি কিছু তথ্য নিতে আসছি।’ এরপর মিজান বলে, ‘আপনি ভেতরে বসেন অসুবিধা নাই। এর কিছুক্ষণ পর কনস্টেবল মিজানসহ দুই তিনজন এসে ওর ব্যাগ কেড়ে নেয়। বলে যে, ‘আপনি এতদিন অনেক রিপোর্ট করেছেন, স্বাস্থ্য খাত নিয়ে অনেক নেতিবাচক রিপোর্ট করছেন। আপনাকে মাটিতে পুঁতে ফেলব’।
পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রোজিনা ‘হয়রানির শিকার হচ্ছেন’ বলে অভিযোগ করেন তার ছোট বোন। মিজানসহ অন্যরা রোজিনার ব্যাগ কেড়ে নিয়েছিল অভিযোগ করে তিনি বলেন, তখন ব্যাগে কিছু ডকুমেন্ট ঢুকিয়ে দিয়ে থাকতে পারে।
রোজিনার স্বামী মনিরুল ইসলাম মিঠু বলেন, আমার স্ত্রী একজন সৎ সাংবাদিক। এর আগেও বহু দুর্নীতির রিপোর্ট করে তিনি রোষানলে পড়েছিলেন। আজকের ঘটনা তার প্রতিফলন।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু বলেন, কোনো নিরপরাদ সাংবাদিক যেনো কোনো হয়রানির শিকার না হয়, সেটা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, রোজিনা ইসলাম অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় অনন্য। আন্তর্জাতিকভাবে তার স্বীকৃতি আছে। এমন একজন সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গেলে তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রাখা অন্যায়, অনভিপ্রেত। সচিবালয়ে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ কি কারণে এভাবে আটকে রাখা হয়েছে, অসুস্থ হওয়ার পরও তাকে হাসপাতালে না নেওয়ার বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার। রোজিনাকে হেনস্তা করার পেছনে দায়ীদের খুঁজে বের করতে হবে।