বঙ্গনিউজবিডি ডেস্ক : টানা ১১ দিন অবরুদ্ধ গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শেষে যুদ্ধবিরতি কার্যকর ও ফিলিস্তিনে আরও একবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হওয়ার পর অনেক ফিলিস্তিনি বলছেন, প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে অবশ্যই ক্ষমতা ছাড়তে হবে। ইসরায়েলি আগ্রাসন ঠেকাতে ন্যূনতম প্রতিরোধ গড়তে ব্যর্থতার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে।
গত বৃহস্পতিবার (২০ মে) গাজায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর পশ্চিম তীর ও গাজায় ফিলিস্তিনিরা বিজয় উদযাপনে রাস্তায় নামতে শুরু করে। পরদিন শুক্রবার সকালে দখলকৃত পূর্ব জেরুজালেমে অবস্থিত আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে সমবেত ফিলিস্তিনিদের মধ্যে অনেকে, ‘মানুষ তাকে ক্ষমতাচ্যুত দেখতে চায়’ বলে স্লোগান দিচ্ছিলেন।
তারা অবশ্যই ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে উদ্দেশ্য করেই এমন স্লোগান দিচ্ছিলেন। আব্বাস যে যে ফাতাহকে নেতৃত্ব দেন, ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের (পিএ) সরকারে সেই ফাতাহ আধিপত্য করে আসছে দীর্ঘদিন। কিন্তু এই সরকার ইসরায়েলের দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড পশ্চিম তীরে সীমিত আকারে কিছু স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে।
সম্প্রতি পশ্চিম তীর থেকে বিচ্ছিন্ন হামাস নিয়ন্ত্রণাধীন গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল যে সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছে তার শুরু চলতি মাসের গোড়ার দিকে। ইসরায়েলি সেনারা ইসলামের তৃতীয় পবিত্র স্থান আল-আকসায় ঢুকে ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারী ও নামাজরত মুসল্লিদের ওপর হামলা করলে দুই পক্ষের মধ্যে সহিংসতার শুরু হয়, যা পরে সামরিক সংঘাতে গিয়ে ঠেকে।
পবিত্র শবে কদরের রাতে জেরুজালেমে অবস্থিত আল-আকসায় ঢুকে ইসরায়েলের হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে গাজার সশস্ত্র শাসকগোষ্ঠী হামাস আল-আকসা প্রাঙ্গণ থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের জন্য তেল আবিবকে আল্টিমেটাম দেয়। কিন্তু তেল আবিব তাতে পাত্তা না দেওয়ায় হামাস প্রথমে ইসরায়েল লক্ষ্য করে রকেট হামলা শুরু করে।
ইসরায়েলও পাল্টা বিরতিহীনভাবে গাজায় বোমা হামলা শুরু করলে শতাধিক নারী-শিশুসহ ১১ দিনে ২৩০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়। সংঘর্ষ হয় পশ্চিম তীরেও। সেখানেও ১৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন। হামাসের রকেট হামলায় ইসরায়েলেও ১৫ জনের মৃত্যু হয়। শেষে গত বৃহস্পতিবার হয় যুদ্ধবিরতি। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা তাদের বর্তমান সরকার ও নেতৃত্ব নিয়ে খুশি নন।
পশ্চিম তীর থেকে বিচ্ছিন্ন গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাস প্রতিরোধ গড়ে তুললেও খোদ পশ্চিম তীরের ফাতাহ তথা ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ ও প্রেসিডেন্ট আব্বাসের পক্ষ থেকে তেমন কোনো প্রতিবাদ-প্রতিরোধ দেখতে না পাওয়ায় নাখোশ ফিলিস্তিনিরা। এতে করে আব্বাসের নেতৃত্বে ভবিষ্যত স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তাদের স্বপ্ন আরও ফিকে হয়ে যায়।
আল-আকসায় হামলার ভিডিও টুইট করে একজন যেমন লিখেছেন, ‘বিশ্বের মুসলিমরাও মাহমুদ আব্বাসকে চান না, যিনি জায়নবাদী আগ্রাসন ও নিপীড়নের সামনে নীরব ছিলেন।’ আরেকজন মাহমুদ আব্বাসের পদত্যাগ চেয়ে লিখেছেন, ‘আমাদের সঠিক পথে যাওয়ার জন্য এটা খুবই প্রয়োজনীয় একটি পদক্ষেপ হবে।’
নেতৃত্ববিহীন বিদ্রোহ যুদ্ধবিরতির দিকে ঠেলে দিয়েছে
ইসরায়েলি আগ্রাসন ঠেকাতে আব্বাস সক্রিয় কোনো ভূমিকা পালন করছেন না— দীর্ঘদিন ধরে তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারী ও অ্যাক্টিভিস্টদের। আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে কৃতিত্ব না দিয়ে তাই তাদের অনেকে বলছেন যে, এটা ছিল নেতৃত্ববিহীন বিদ্রোহ যা যুদ্ধবিরতির দিকে ঠেলে দিয়েছে।
তবে এই প্রথম যে ইসরায়েলি সেনারা আল-আকসায় ঢুকে হামলা চালালো কিংবা ইসরায়েলি বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে গাজা উপত্যকা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হলো ব্যাপারটা এমন নয়। কিন্তু এবার পশ্চিম তীরে বিশেষ করে দখলকৃত পূর্ব জেরুজালেমে তরুণদের নেতৃত্বে ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিরোধটি ছিল উল্লেখ করার মতো।
ইসরায়েল আল-আকসায় হামলা চালানোর আগে পূর্ব জেরুজালেমের পাশের ছোট এলাকা শেখ জারায় ইসরায়েলি সেনারা ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে অভূতপূর্ব এক প্রতিরোধ লড়াই প্রত্যক্ষ করেছে। বিশেষ করে সেখানকার তরুণ বাসিন্দাদের দ্বারা।
ঘটনা এপ্রিলের। ইসরায়েলি আদালত শেখ জারায় ছয়টি বাড়ি থেকে জোরপূর্বক মুসলিম বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করার রায় দেয়। যার অর্থ হলো তারা তাদের বাড়িঘর ইসরায়েলি ইহুদি সেটেলারদের না দিতে চাইলে পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে তাদের উচ্ছেদ করতে হবে। ইতোমধ্যে বসতি গড়ে চারপাশ দখল করে নিয়েছে এসব ইহুদি।
এই ঘটনা নিয়ে মুহূর্তেই সবার আগে সামাজিক মাধ্যমে আলোড়ন তৈরি হয়। পরে তা ঠাঁই পায় মূলধারার গণমাধ্যমে। আর এর কৃতিত্ব মূলত মোহাম্মদ আল কুর্দ ও মুন্না আল কুর্দের মতো তরুণ বাসিন্দাদের। বিক্ষোভকারীরা হালনাগাদ তথ্য দিয়ে ইসরায়েলি অপরাধ কার্যকলাপ দৃশবন্দি করে তা মানুষকে জানাতে থাকে।
শেখ জারায় অবৈধ এই জোরপূর্বক উচ্ছেদ নিয়ে সম্মুখসারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে কুর্দ পরিবার। তারা বিক্ষোভ প্রতিবাদের আয়োজন করেছে। আর এ কারণেই ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্ট জোরপূর্বক উচ্ছেদ সংক্রান্ত আদেশ স্থগিত করতে বাধ্য হয়। ধীরে আরও প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে ফিলিস্তিনের মানুষ। তারাও বিক্ষোভে যোগ দেয়।
গত ১৫ মে মোহাম্মদ কুর্দের টুইটার হ্যান্ডেলকে ট্যাগ করে একজন টুইট করেন, ‘মাহমুদ আব্বাসের সরে যাওয়া উচিত এবং মোহাম্মদ কুর্দের মতো তরুণদেরকে ফিলিস্তিনের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দিতে হবে। তবে এই একজন কিংবা এবারই ফিলিস্তিনিরা আব্বাসের প্রতি যে তাদের হতাশা প্রকাশ করলেন ব্যাপরটা এমন নয়।
৮৫ বছর বয়সী ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের মেয়াদ আনুষ্ঠানিকভাবে ২০০৯ সালে শেষ হয়েছে। কিন্তু তিনি ডিক্রি জারি করে অবৈধভাবে বিগত ১২ বছর ধরে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের সরকার প্রধান রয়ে গেছেন।
নেতৃত্ব নিয়ে হতাশ ফিলিস্তিনিরা এবার পরিবর্তন চান। আগামী ৩১ জুলাই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও আবার তা পিছিয়ে দিয়েছে মাহমুদ আব্বাসের সরকার। তার আগে ফিলিস্তিনিরা তাদের স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নপূরণে নতুন নেতা নির্বাচিত করতে চাচ্ছেন। প্রায় সব ফিলিস্তিনির মধ্যে এই ঝোক দেখা যাচ্ছে।
নির্বাচনের ঘোষণা করার পর সম্প্রতি মাহমুদ আব্বাস ইসরায়েল দখলকৃত পূর্ব জেরুজালেমের বাসিন্দাদের ভোটে অংশ নিতে রাজি হওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচন স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছেন।
অনেকে বলছেন, জনপ্রিয়তা না থাকায় আব্বাস নির্বাচন পেছানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এছাড়া দলে নাসের আল কুয়াদার মতো নেতার আবির্ভাব। নাসের ফাতাহ’র প্রতিষ্ঠাতা ও ফিলিস্তিনের প্রথম প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাতের ভাতিজা। এছাড়া নির্বাসিত নেতা মোহাম্মদ দাহলানও তার বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।