বঙ্গনিউজবিডি ডেস্ক: নীলফামারী সদরের রেজওয়ান আলী (৩০) পেশায় একজন রিকশাচালক। স্ত্রী মজিদা বেগম (২২) স্থানীয় একটি কারখানার শ্রমিক। দুই মেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়ে তাঁদের সংসার। সুখে–দুঃখে সবাই মিলে থাকেন সদরের বউবাজার গ্রামে। আজ বুধবার (৮ ডিসেম্বর) সকালে ট্রেনে কাটা পড়ে একসঙ্গে তিন সন্তানের মৃত্যু তাঁদের চিরদিনের মতো দুঃখী বানিয়ে গেল।
রেললাইনের ধারে রেলের একখণ্ড জমিতে ছোট একটি ঘর বানিয়ে থাকেন রেজওয়ান–মজিদা দম্পতি। বাড়ির পাশের রেললাইনের ওপর খেলার সময় ট্রেনে কাটা পড়ে আজ মারা যায় তাঁদের দুই মেয়ে লিমা আক্তার (৭) ও সিমু আক্তার (৪) এবং ছেলে মো. মোমিনুর রহমান (২)। তাদের বাঁচাতে গিয়ে মনষাপাড়া গ্রামের সালমান ফারাজি ওরফে শামীম (৩০) ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান।
তিন শিশুর বাবা রেজওয়ান আলী বলেন, প্রতিদিন সকালে সন্তানদের সঙ্গে নাশতা করে কাজে চলে যান স্বামী–স্ত্রী। বাচ্চারা তাদের মতো রেললাইনের আশপাশে খেলাধুলা করে। সন্ধ্যায় তাঁরা (স্বামী–স্ত্রী) ঘরে ফেরেন। বাকিটা সময় সন্তানদের সঙ্গে কাটান। আজ সকালেও বাচ্চাদের এভাবে রেখে কাজে যান স্বামী–স্ত্রী। কিছুক্ষণ পরই দুর্ঘটনার খবর পান। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন, তিন সন্তানের কেউই আর বেঁচে নেই।
স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, রেজওয়ান আলীর বাড়ির পাশে দিনাজপুর খালের ওপর একটি রেলসেতুর সংস্কারকাজ চলছিল। ওই কাজের ইট নিয়ে সেখানে একটি ট্রলি আসে। ট্রলিটি সেখানে আটকা পড়লে শিশুরা তা দেখতে যায়। সেখানে তারা খেলছিল। এ সময় চিলাহাটি থেকে ছেড়ে আসা রকেট মেইল ট্রেনটি খুলনার দিকে যাচ্ছিল। সকালে ঘন কুয়াশার কারণে বেশি দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল না। আর ট্রলির শব্দের কারণে ট্রেনের শব্দও বোঝা যায়নি।
ট্রেন আসতে দেখে সেতু সংস্কারকাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পাহারাদার সালমান ফারাজি বাচ্চাদের রক্ষা করতে যান। তিনি শিশু মোমিনুরকে কোলে নিয়ে রেললাইন থেকে লাফ দেওয়ার আগেই ট্রেনের ধাক্কায় ছিটকে পড়েন। লিমা ও সিমু ঘটনাস্থলেই মারা যায়। স্থানীয় লোকজন সালমান ও মোমিনুরকে উদ্ধার করে নীলফামারী আধুনিক সদর হাসপাতালে নেওয়ার পথে তাঁদের মৃত্যু হয়।
এরপর সকাল ১০টার দিকে চিলাহাটি থেকে ছেড়ে আসা খুলনাগামী আন্তনগর রূপসা এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঘটনাস্থলে পৌঁছালে উত্তেজিত এলাকাবাসী ট্রেনটি আটকে বিক্ষোভ করেন। পরে নীলফামারীর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোখলেছুর রহমান ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। এর ঘণ্টাখানেক পর ট্রেনটি গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যায়।
দুপুর ১২টার দিকে তিন শিশুর লাশ বাড়িতে নিয়ে এলে আশপাশের লোকজন সেখানে ভিড় জমান। মা মজিদা বেগম একসঙ্গে তিন সন্তানকে হারানোর শোকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। শিশুদের বাবা রেজওয়ান বলেন, ‘সকালে স্ত্রীকে তাঁর কারখানায় নামিয়ে দিয়ে আমি শহরে রিকশা চালাতে বের হই। সাড়ে আটটার সময় খবর পাই দুর্ঘটনার। ততক্ষণে আমার সব স্বপ্ন শেষ। আমি কী নিয়ে বাঁচব?’
রেজওয়ানের বড় বোন রোকসানা বেগম (৫০) বলেন, ‘একটি ছেলেসন্তানের জন্য একে একে তিনটি সন্তান নিয়েছেন আমার ভাই–ভাবি। এখন ছেলে–মেয়ে কেউ থাকল না। তাঁরা বাঁচবেন কীভাবে?’
প্রতিবেশী বেগপাড়া গ্রামের আলিমন নেছা (৬০) বলেন, ‘কাল রাতেও ছেলে–মেয়ের সঙ্গে খেয়েছেন। রাতে এক বিছানায় ঘুমিয়েছেন। আর আজ সকালে তাঁদের সব শেষ হয়ে গেল!’
নীলফামারী সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহিদ মাহমুদ বলেন, উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে দাফনের জন্য রেজওয়ান আলীর পরিবারকে ৩০ হাজার এবং সালমান ফারাজির পরিবারকে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।
সৈয়দপুর রেলওয়ে থানার (জিআরপি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুর রহমান বলেন, লাশের সুরতহাল করে দাফনের জন্য অভিভাবকদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোখলেছুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেন, এ ধরনের ঘটনার যাতে আর না ঘটে, সে জন্য স্থানীয় লোকজনকে সচেতন হতে হবে।