ডেস্ক : এম ইলিয়াস আলী ইস্যুতে দেয়া আলোচিত বক্তব্যের যে ‘ব্যাখ্যা’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস দলকে দিয়েছেন, তা সন্তুষ্ট করতে পারেনি হাইকমান্ডকে। যদিও এজন্য আব্বাসের বিরুদ্ধে বিএনপির তরফ থেকে কোনো কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে না। তবে এর জের মির্জা আব্বাসকে বহুদিন বয়ে বেড়াতে হতে পারে। এমনকি বিএনপিতে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েও তৈরি হতে পারে শঙ্কা। দলীয় বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে এমনটি জানা গেছে।
বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীর ‘নিখোঁজ’ হওয়ার নয় বছর উপলক্ষে গত ১৭ এপ্রিল আয়োজিত এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় মির্জা আব্বাস বলেছিলেন, ‘ইলিয়াস আলী নিখোঁজের পেছনে দলের (বিএনপি) একটা অংশ জড়িত। সরকার ইলিয়াস আলীকে অপহরণ করেনি।’
তার এমন বক্তব্যে দলের ভেতরে-বাইরে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়। লুফে নেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এরপর দলের পক্ষ থেকে চাপে পড়ে পরদিন (১৮ এপ্রিল) নিজের শাহজাহানপুরের বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন করেন মির্জা আব্বাস। সেখানে তিনি দাবি করেন, মিডিয়ায় তার বক্তব্য খণ্ডিত করে প্রচার করা হয়েছে। যদিও হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে মির্জা আব্বাসকে একটি লিখিত চিঠি দেয়া হয়েছিল, বলা হয়েছিল সংবাদ সম্মেলনে তিনি শুধু ওই চিঠি পাঠ করবেন। কিন্তু সেটা না করে তিনি তার ‘মনমতো’ বক্তব্য দেন বিধায় আরও নাখোশ হয় হাইকমান্ড।
এরপর গত ২২ এপ্রিল মির্জা আব্বাসকে ওই বক্তব্যের লিখিত ব্যাখ্যা দিতে দলের পক্ষ থেকে আরেকটি চিঠি দেয়া হয়। ২৬ এপ্রিল তিনি চিঠির জবাব দেন।
দলীয় সূত্র মতে, চিঠির জবাবে মির্জা আব্বাস লিখেছেন, ‘আমার অনিচ্ছাকৃত বক্তব্যে যদি দলের কোনো ক্ষতি হয়ে থাকে তার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। আশা করি, আমার এই পত্রের মাধ্যমে দলে ও দলের বাইরে চলমান সব ধরনের ভুল বোঝাবুঝির অবসান হবে।’
তিনি লেখেন, ‘১৭ এপ্রিল যখন আমি ভার্চুয়াল বক্তব্য রাখি ঠিক তার পরমুহূর্তে স্থায়ী কমিটির মিটিং ছিল। আমার বক্তব্য রাখার সময় বক্তব্য সংক্ষিপ্ত করার তাড়া আসে। তাই কথাগুলো যেভাবে বলতে চেয়েছি, সেভাবে বলতে পারিনি। বক্তব্য রাখার সময় এমন কিছু শব্দ চলে এসেছে সেগুলো ইচ্ছাকৃত নয়। আমি কোনো বক্তব্য দলকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য বলিনি। এরপরও ভুলত্রুটি হয়ে থাকলে তা অনিচ্ছাকৃত। সেদিন সময় পেলে এমনটা হতো না।’
মির্জা আব্বাস বলেন, ‘এই বক্তব্য আমার রাজনৈতিক আদর্শকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিয়েছে। তারপরও বলতে চাই, যেকোনো পরিস্থিতিতে দলের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের কূটকৌশলের যথাযথ জবাব দেয়ার জন্য আমি প্রস্তুত থাকবো। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি বর্তমান ফ্যাসিবাদী সরকার তার অনৈতিক শাসন দীর্ঘায়িত করতে, একই সঙ্গে বিএনপি ও বিরুদ্ধ মতবাদকে ধ্বংস করতে গুম, খুন, নির্যাতন, দমন-পীড়ন ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। ইলিয়াস আলীসহ এ যাবত যত রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী গুম হয়েছেন, তা বর্তমান সরকার করেছে।’
‘আওয়ামী লীগ ও তাদের আজ্ঞাবহ মিডিয়া আমাকে ও দলকে যেমন বেকায়দায় ফেলেছে, তেমনি আমার দলও আমার বক্তব্যের অন্তর্নিহিত বিষয়গুলো অনুধাবন করার চেষ্টা না করে আওয়ামী লীগের কূটকৌশলের জবাব না দিয়ে এই চিঠি প্রেরণ করে আমাকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে।’
১৮ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে ওই বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে জানিয়ে চিঠির শুরুতে মির্জা আব্বাস লেখেন, ‘দীর্ঘ ৪৫ বছরের মধ্যে যা কখনো ঘটেনি, এমন একটি অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্ক্ষিত ও বেদনাদায়ক ঘটনার সম্মুখীন আমাকে হতে হয়েছে এই চিঠির মাধ্যমে। ব্যক্তিগত জীবনে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে রাজনীতিতে এসে আজ অবধি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দল ও জিয়া পরিবারের প্রতি আমার নিষ্ঠা ও কর্তব্য পালনে এবং রাজনৈতিক জীবনে কখনোই সংগঠনের জন্য ক্ষতিকর কিছু করিনি।’
তিনি বলেন, ‘ওই দিনের বক্তব্যের মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছি—ইলিয়াস আলী ও (বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য) সালাহউদ্দিন আহমেদ গুম একই সূত্রে গাঁথা। সরকার বলছে তারা করেনি। আমি মূলত সরকারের বক্তব্য কটাক্ষ করতে চেয়েছি। আমার কটাক্ষ করা বক্তব্য ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।’
মির্জা আব্বাস আরও বলেন. ‘বড় দলে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থাকে, নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা, গ্রুপিং থাকে। এই গ্রুপিং যেন বাইরের কেউ ব্যবহার করে দলের নেতাদের ক্ষতিসাধন না করতে পারে তার পরামর্শ দিয়েছি। কিন্তু সেটিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও তার আজ্ঞাবহ গণমাধ্যম আমার বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মির্জা আব্বাসের এই চিঠি বিএনপির হাইকমান্ডের মনঃপূত না হলেও এ যাত্রায় তাকে দল থেকে বড় ধরনের শাস্তি পেতে হচ্ছে না। তবে এই ঘটনার মধ্য দিয়ে তাকে কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকতে হতে পারে।
দলে মির্জা আব্বাসের সমমনা একটি অংশ বলছে, বিএনপির জন্মলগ্ন থেকে মির্জা আব্বাস একটি নিজস্বতা নিয়ে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামে জায়গা পেয়েছেন। তার সম্পর্কে সবাই ধারণা রাখেন। তিনি তার বক্তব্যে যাই বলুন না কেন, আপাদমস্তক সাচ্চা জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে তাকে নিয়ে ন্যূনতম কারও সন্দেহ নেই।
ওই অংশটি মনে করে, দলের মধ্যে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা রয়েছে, সেখানে একটা অংশ মির্জা আব্বাসের এই সীমাবদ্ধতাকে পুঁজি করে ফায়দা লুটতে চাইছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দল থেকে বিএনপিতে এসে যারা দলের অলংকৃত পদ-পদবি নিয়ে বা সরকারে থাকাকালে এমপি-মন্ত্রী হয়ে নিজেদের সমৃদ্ধ করেছেন, তারা এখন দলের নীতি-নির্ধারণীতে প্রভাব বিস্তার করছেন। মির্জা আব্বাসের মতো একজন নেতাকে দল থেকে বহিষ্কারের দরকার নেই। মির্জা আব্বাসের সঙ্গে যা করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে। আরও প্রায় ছয় মাস আগে থেকেই দলীয় হাইকমান্ডের সঙ্গে মির্জা আব্বাসের দূরত্ব তৈরিতে দলের ওই ‘সুবিধাবাদী’ গ্রুপ ভূমিকা রেখেছে। হাইকমান্ড ঘনিষ্ঠ একটি পক্ষই মির্জা আব্বাসের সঙ্গে দলের শীর্ষ পর্যায়ের মুখোমুখি অবস্থান তৈরি করেছে।
তবে মির্জা আব্বাস যে দলে আগের মতো কদর-সমাদর পাবেন না, সেটাও বোঝেন তার সমমনা ওই অংশ। তারা বলছেন, বিএনপিতে আব্বাসের যারা ঘনিষ্ঠ অনুসারী রয়েছেন, রাজনীতি করতে হলে তারাও সুবিধার জন্য এই নেতার কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখবেন।
তবে একাধিক শীর্ষ নেতার অভিমত, মির্জা আব্বাস যে বক্তব্য দিয়ে বিতর্কিত হয়েছিলেন তার জন্য তিনি হাইকমান্ডের কাছে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা পেয়েছেন। একইসঙ্গে দলের পক্ষ থেকে কড়া সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছে, দলের কাছে সবাই গুরুত্বপূর্ণ হলেও কেউই অপরিহার্য নয় এবং কেউ কাউকে ‘জমা-খরচ’ না দিয়ে চললেও দলের কাছে সবার জবাবদিহি করতে হবে।
মির্জা আব্বাসের ব্যাখ্যায় দল সন্তুষ্ট কি-না এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কিছু বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের দলের ভেরি মাচ ইন্টার্নাল (খুবই অভ্যন্তরীণ বিষয়)।’