বঙ্গনিউজবিডি ডেস্ক : মানুষের জীবনের শুরুতে থাকে বিভীষিকাময় সব অধ্যায়। অনেকেই বাবার অভাবের সংসারে বেড়ে ওঠেন, স্বামীর সংসারে গিয়েও সুখের দেখা পান না। তেমনি একজন মোরশেদা বেগম। জীবনে সুখের দেখা না পেয়েও দমে যাননি। জীবনের নানা বাঁক অতিক্রম করে আজ তিনি পেয়েছেন সুখের দেখা।
সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে। বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে মাত্র ৮ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করেন কাপড়ের ব্যবসা। সেখান থেকে এখন বছরে আয় করেন লাখ লাখ টাকা।
বলছিলাম একজন সফল নারী উদ্যোক্তা স্বামী-পরিত্যক্তা মোরশেদা বেগমের (৪০) কথা। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আলাপকালে তিনি জানান তার সংগ্রাম, সফলতা ও শিখরে ওঠার গল্প।
২০০১ সালে পারিবারিকভাবে ভোলা জেলার বাসিন্দা খোকন ডাক্তার ও আঙ্কিজা বিবির ছেলে শহিদুল হকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন মোরশেদা। বিয়ের তিন বছর পর শহিদুল হক ও মোরশেদা বেগমের ঘর আলো করে পৃথিবীতে আসে এক মেয়ে ও ছেলে। কিন্তু দেনায় জর্জরিত হয়ে নিরুদ্দেশ হন শহিদুল। সেই থেকে একা একা শুরু হয় পথচলা।
মোরশেদা বেগম বলেন, জন্মের আড়াই বছর বয়সে মা হারিয়ে এতিম হই। পরে সৎমা ঘরে তোলেন বাবা। তাই খালার কাছে মানুষ হই। শহরের কমলা বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সৌভাগ্য হয়। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে আর পড়াশোনা করতে পারিনি। ২০০১ সালে যখন আমার (স্বামী শহিদুল হক) বিয়ে হয়, তখন জীবন সুন্দর ছিল। স্বামীর মাছের আড়ত ছিল। টাকাপয়সাও ছিল। সবকিছু সুন্দরভাবে চলছিল।
২০০৪ সালে মেয়ের জন্মের পর শহিদুল হকের ব্যবসায় মন্দা নামে। আমার বাবা (বেলায়েত মল্লিক) ও বড় বোন (হাসি বেগম) আমাদের নিয়ে আসেন। এরপর শুরু হয় আরও কষ্টের জীবন। বেকার হয়ে পড়ে শহিদুল। সংসারে খরচ জোগাতে গৃহকর্মীর কাজ নেই। দীর্ঘদিন গৃহকর্মীর কাজ করি। রাস্তায় ইট ভাঙার কাজ করি।
পরে ২০০৯ সালে শহরের লঞ্চঘাটে কাপড়ের দোকান দেয় শহিদুল। এরপর জন্ম হয় ছেলে শাওনের। ২০১০ সালে আবারও ব্যবসায়িক মন্দার কারণে দোকান বন্ধ হয়ে যায়। দেনায় পড়ে যাই আমরা। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে আবারও ঢাকায় যাই। কিন্তু কিছুতেই কোনো কিছু না হওয়ায় আবার ফিরে আসি।
২০১৫ সালে টুকটাক ব্যবসা, ব্যবসায় মন্দা ও দেনায় পড়ে শহিদুল অসুস্থ হয়ে যায়। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে সে বাড়ি থেকে চলে যায়। দীর্ঘদিনেও আর ফিরে আসেনি ও। পরে শুনেছি অনত্র্য বিয়ে করেছে। কিন্তু আমি তা নিয়ে এখন আর ভাবছি না। নিজেকে তৈরি করেছি। কষ্ট করেছি। আজ আমি সফল হয়েছি। এতেই সন্তানদের নিয়ে সুখ খুঁজি।
সফলতার দ্বারপ্রান্তে কখন পৌঁছালেন, তিনি বলেন, শেষের যে দোকানটি ছিল, পাওনাদারদের কাছ থেকে অনেক অনুনয়-বিনয় করে টুকরা কাপড় আনি। সেই কাপড় বিক্রি করে ১০ হাজার টাকা হাতে পাই। সেই টাকা দিয়ে নতুন করে ভাড়া বাসায় দুই সন্তান নিয়ে বসবাস শুরু করি। সেখান থেকে ৮ হাজার টাকা দিয়ে ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট থেকে থ্রি-পিস আনি। এরপর শুরু হয় বিক্রি।
বর্তমানে কেমন লাভ হয়, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রথমে ২ হাজার টাকা বিক্রি দিয়ে নিজের ঘরোয়া দোকান শুরু হয়। ধীরে ধীরে গ্রাহক বাড়ে। তার সঙ্গে বাড়ে বেচাবিক্রিও। বাড়ে আয়ের পরিধি। বর্তমানে প্রতি মাসে আমি ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকার বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি করছি। এতে সব বাদ দিয়ে লাভ থাকে ৩০ হাজার টাকা।
এদিকে মোরশেদার ঘুরে দাঁড়াতেই আসে আরেক সুখবর। ২০২২ সালে এসএসসি পরীক্ষার প্রকাশিত ফলাফলে বড় মেয়ে আনজুমান আরা সুইটি বিজ্ঞান বিভাগ থেকে (গোল্ডেন) অর্জন করে। এখন স্বপ্ন দেখেন মেয়েটিকে ভালোভাবে পড়ালেখা করাবেন। তারপর মেয়ে একটি সরকারি চাকরি করবে। ছেলেকেও চান মানুষের মতো মানুষ করতে।
মায়ের দীর্ঘ প্রতীক্ষা ও কষ্ট অনুভব করে আনজুমান আরা সুইটি। সে বলে, বাবা তো সেই কবে আমাদের ফেলে চলে গেছেন। মায়ের কারণে আজ আমি এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। মা না থাকলে আজ পড়াশোনা হতো না। এই ফলও করতে পারতাম না। এ পর্যন্ত আসার পেছনে আমার মায়ের অবদান অনেক। আমার মাকে নিয়ে গর্ববোধ করি।
মোরশেদার কাছ থেকে সব সময় কাপড় কেনেন আকলিমা বেগম। তিনি বলেন, মোরশেদার কাপড়ের মান ভালো, দামও কম। পণ্য ভালো হওয়ায় এখান থেকে সব সময় কিনি।
প্রতিবেশী রোকেয়া হোসেন বলেন, মোরশেদা ভাবি অনেক পরিশ্রমী একজন মানুষ। তার জীবন আর দশজনের মতো সহজ ছিল না। আমরা দেখেছি কীভাবে স্বামী রেখে গেলেও নারীরা সফল হতে পারে। কীভাবে সাবলম্বী হওয়া যায়, সন্তান মানুষ করা যায়, তার উদাহরণ হতে পারেন মোরশেদা।
প্রতিবেশী রোকেয়া হোসেন বলেন, মোরশেদা ভাবি অনেক পরিশ্রমী একজন মানুষ। তার জীবন আর দশজনের মতো সহজ ছিল না। আমরা দেখেছি কীভাবে স্বামী রেখে গেলেও নারীরা সফল হতে পারে। কীভাবে সাবলম্বী হওয়া যায়, সন্তান মানুষ করা যায়, তার উদাহরণ হতে পারেন মোরশেদা।