বঙ্গনিউজবিডি রিপোর্ট : বর্ষায় বৃষ্টির পানি আর গোমতী ও মেঘনা নদী উপচে আসা পানিতে তলিয়ে যায় কুমিল্লার দাউদকান্দির বিস্তৃর্ণ এলাকা। এসব এলাকার জমি অন্তত ছয় মাস থাকে পানির নিচে, তখন ফসল ফলাতে পারেন না চাষিরা। এরপর শুস্ক মৌসুমে পানি নেমে যায়। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্লাবন ভূমিতে মাছ চাষ আর পানি নেমে গেলে সেখানে করা হয় ধান চাষ। এভাবে প্লাবন ভূমিতে সমন্বিত মাছ ও ধান চাষের পদ্ধতি ‘দাউদকান্দি মডেল’ বলে পরিচিত। একই জমিতে মাছ ও ধান চাষ করা মডেলটি সারা দেশে এমনকি সার্কভুক্ত দেশেও প্রশংসিত হয়েছে।
দাউদকান্দির বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে এমন শতাধিক মৎস্য প্রকল্প। এসব প্রকল্পে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক কর্মসংস্থান। সমাজবদ্ধভাবে মাছ চাষের উদ্যোক্তাদের রয়েছে কঠোর পরিকল্পনা ও পরিশ্রম। এসব উদ্যোক্তার একজন আলী আহাম্মদ মিয়াজী।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ছেড়ে গ্রামের মেঠো পথ পেরিয়ে কুমিল্লার দাউদকান্দির বেকিনগরে গেলেই দেখা মিলবে প্লাবন ভূমিতে মাছ আর ধান চাষের উপাখ্যান। ছয়মাস সোনাফলা ধান আর একই জায়গায় বাকী ছয়মাস রুপালী মাছের চাষ। এটা সমাজের যুথবদ্ধ মানুষের যৌথ প্রয়াস।
রূপালি মাছ, চাষিদের চোখে রঙিন ঝিলিক, কর্মব্যস্ত মানুষের প্রাণচাঞ্চল্য, ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁক-ডাক, সব মিলে যেন তৈরি আলাদা এক জগৎ। ভাত-মাছের ১৬ আনাই বাঙ্গালীয়ানা। যে জমি দেয় ভাত, সে জমিই আবার হয়ে উঠে মাছের ভান্ডার। প্লাবন ভূমিতে মাছ চাষ সারাদেশেতো বটেই আন্তর্জাতিক ভাবেও জনপ্রিয় ‘দাউদকান্দি মডেল’। বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিধি দল আসেন দাউদকান্দিতে গড়ে উঠা প্লাবন ভূমিতে মৎস্য চাষ প্রকল্প দেখতে।
দাউদকান্দি উপজেলায় বাৎসরিক মাছের চাহিদা ৬ হাজার ৯৮৭ মেট্রিক টন। গত বছর উৎপাদন হয় ৪৫ হাজার ৩শত ৫৯ মেট্রিকটন। এর মধ্যে প্লাবন ভূমির জমি থেকে মাছ পাওয়া যায় প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন। যা স্থানীয় চাহিদার চেয়ে প্রায় ৩৯ হাজার ৩শত ৭২ মেট্রিক টন বেশি।
তিন দশক আগে এখানকার ধানুয়াখোলা গ্রামের সুনীল বাবু যে স্বপ্নের বীজ রোপন করেছিলেন। আজ সেই বীজ, ডাল-পালা ছড়িয়ে মহীরুহ হয়ে উঠেছে। যেখানে চিত্রায়ণ হচ্ছে প্লাবন ভূমিতে মাছ উৎপাদনে, দেশ সেরা ১১৬টি জলাশয়ে, মাছ আর জালের শৈল্পিক মহাকাব্য। সেই কাব্যের একটি গুরুত্বপূর্ন চরিত্র, রঙ্গিন স্বপ্ন ছড়িয়ে দেওয়া গ্রামীন জনপদের অন্যতম সফল মৎস্য চাষী আলী আহম্মেদ মিয়াজী। তিন হাজার ছয়শত বিঘা জমিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তার স্বপ্নের জাল। আটটি মৎস্য প্রকল্পের ব্যবস্থপনা পরিচালক তিনি।
আলী আহম্মেদ পড়াশোনায় মাধ্যমিক গন্ডি পেরিয়েই জড়িয়ে পড়েন প্লাবন ভূমিতে মাছ চাষে। মাঝে উন্নত জীবনের আশায় পাড়ি জমান প্রবাসে। বছর তিনেক পর দেশে ফিরেই আবার শুরু হয় স্বপ্নের পথযাত্রা। সরাসরি চারশত মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে তার আটটি প্রকল্পে।
উপজেলা-জেলায় সেরা- সরকারীভাবে পুরুষ্কারপ্রাপ্ত মৎস্য উদ্যোত্তা, জাতীয়ভাবে মাছ উৎপাদনে ভূমিকা রাখতে পেরে গর্বিত মনে করেন নিজেকে।
প্রায় দেড়শত গ্রামে লক্ষাধিক মানুষের সচ্ছলতা ফিরেছে তারই এই প্রকল্পের মাধ্যমে। ব্যস্ত জনপদে কমে এসেছে বেকারত্ব ও মাদকসেবীদের উপদ্রব।
কথা হয় মাছের পাইকারী ক্রেতা সেলিম মিয়ার সাথে। তিনি জানান, এখান থেকে মাছ কিনে বিভিন্ন বাজারে নিয়ে বিক্রি করেন তিনি।
তার মত প্রচুর পাইকারী ও খুচরা ক্রেতার ভিড় দেখা যায় সকালের প্লাবন ভূমির প্রকল্প এলাকায়। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের একাদশ শ্রেণীর অধ্যয়রণত ছাত্র, মৎস্য প্রকল্পে কর্মরত শামিম বলেন, আমাদের এখানে সবাই মাছ চাষে উৎপাদন থেকে বিপনন পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে নিজেকে জড়িয়ে রাখার সুযোগ পেয়েছেন।
তথ্য, উপাত্ত পর্যালোচনা করে দাউদকান্দিকে মাছের ভান্ডারই মনে করেন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সাবিনা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, ছয় মাস চাষে ধান মৌসুম শুরুর আগে জমিতে আলাদা পরিচর্যা করার প্রয়োজন হয় না। জমি থাকে পরিছন্ন। ধান ফলাতে প্রয়োজন হয় না বাড়তি সারের। তিনি আশা প্রকাশ করেন, প্লাবন ভূমির মাছ চাষ, দাউদকান্দি মডেল এক সময় সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে।
ইতিমধ্যেই দেশের অনেক জায়গায় প্লাবন ভূমিতে মাছ চাষ দাউদকান্দি মডেল অনুসরণ করা হচ্ছে। অনেকেরই প্রত্যাশা, প্লাবন ভূমিতে বর্ষায় পানি ঢুকে বছরের অর্ধেকের বেশি সময় যে জমি জলের নিচে থাকে, সেখানে যদি সারাদেশে দাউদকান্দির প্লাবিত জমির মতো মাছ চাষ করা যায়, তাহলে মৎস্য সম্পদ হবে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান খাত।