এটা জান্নাতের প্রেমপথের সর্বশ্রেষ্ঠ ভালোবাসা। যাতে প্রাপ্তির বন্দনায় আত্মার অনুরাগে উন্মাদিত হাজারো মুমিনের হৃদয়-মন। প্রশান্তির খোঁজে নিজের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার উপকরণ। তৃষ্ণিত হৃদয়ের প্রণয়পাত্র। অসুস্থ ব্যক্তির অন্তরের ব্যাধি। নিজেকে চঞ্চল ও প্রাণবন্ত করার অন্যতম মাধ্যম, যা পূর্ণতা পায় স্রষ্টাকে ভালোবাসার মাধ্যমেই। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘ঈমানদার ব্যক্তি আল্লাহকে ভীষণ ভালোবাসে’ (সূরা বাকারা : ১৬৫)।
হৃদয়ের সজীবতায় আর ভালোবাসার ছোঁয়ায় ঈমানদাররা সারাক্ষণ বিভোর হয়ে থাকে। প্রতিটি অঙ্গের কোনো না কোনো কাজ রয়েছে। আর তার মধ্যে থেকে হৃদয়ের কাজ হলো ভালোবাসা। আর আল্লাহ যাকে ভালোবাসেন, তাকে পার্থিব মোহ থেকে রক্ষা করেন। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, আল্লাহ তায়ালা যখন কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন। তাকে দুনিয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখেন, যেমন তোমাদের কেউ তার রোগীকে পানি থেকে বাঁচিয়ে রাখে (সুনানে তিরমিজি : ২০৩৬)।
যেহেতু পার্থিব জীবনের মোহমায়া সব গুনাহের মূল। আর এই মায়া দূর করা সব কল্যাণের চাবিকাঠি। যে কারণে প্রিয়নবী সা: আল্লাহর ভালোবাসার পাত্র ছিলেন। কারণ সব কিছুর ঊর্ধ্বে রয়েছে আল্লাহর ভালোবাসা। বিশেষ করে মুমিনের জীবনে আল্লাহর ভালোবাসাই সব কিছুর ঊর্ধ্বে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘বলো, তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের সে সম্পদ যা তোমরা অর্জন করেছ, আর সে ব্যবসা যার মন্দা হওয়ার আশঙ্কা তোমরা করছ এবং সে বাসস্থান, যা তোমরা পছন্দ করছ, যদি তোমাদের কাছে অধিক প্রিয় হয় আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর পথে জিহাদ করার চেয়ে, তবে তোমরা অপেক্ষা করো আল্লাহ তাঁর নির্দেশ নিয়ে আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না’ (সূরা তাওবা : ২৪)।
কোনো এক কবি বলেছিলেন, পৃথিবীর যেকোনো বস্তু থেকে তুমি বিচ্ছিন্ন হও ; তার বিকল্প পেয়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহর পথ অনুসরণ না করলে : তাঁর কোনো বিকল্প খুঁজে পাবে না। আল্লাহকে ভালোবাসা ব্যতীত এই দ্বীন নি®প্রাণ চিত্রের মতো। আল্লাহর সঙ্গে মোহব্বত তৈরি হলে বিনয়ী হওয়া যায়। নিজেকে মোমের মতো কোমল করে গঠন করা যায়। কেননা নবী সা: বলেন, আল্লাহ সর্ব বিষয়ে বিনয় ও নম্র আচরণ পছন্দ করেন (মুসলিম : ২১৬৫)।
আর মুমিন হৃদয়গুলো আল্লাহর সাক্ষাতের জন্য মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রতিটি প্রহর গুনতে থাকে। কারণ তারা জানে মৃত্যুপরবর্তী তাদের জীবন কাটাতে হবে জান্নাতের শীতলতায়। যেহেতু জান্নাতেই আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ হবে। আর প্রিয়তমকে একটিবার দেখার জন্য আমরা কতটাই না উদগ্রীব হয়ে থাকি। মুমিন বান্দারা ঠিক ততটাই উদগ্রীব হয়ে থাকে আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভের জন্য! আনাস ইবনে মালিক রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করেন না (মুসনাদে আহমদ : ১৩৪৬৭)।
আল্লাহর সঙ্গে থাকে কারো ব্যক্তিগত ভালোবাসা, আবার কারো ব্যক্তিগত দুশমনিও থাকে। ইমানদারদের সাথে আল্লাহ তায়ালার ব্যক্তিগত ভালোবাসা থাকে। আর কাফেরদের সাথে আল্লাহ তায়ালার ব্যক্তিগত শত্রুতা থাকে। মূলত ভালোবাসার নিদর্শন হলো, প্রেমিক তার প্রিয়তমাকে যত কিছুই দেখ না কেন! সে তাকে সামান্য মনে করে। আর প্রিয়তমা যখন তাকে সামান্য কিছু দেয় তখন সে তাকে সুবিশাল মনে করে। আর আল্লাহ আমাদের এত নিয়ামত দান করেছেন। তার পরও তিনি বললেন, হে নবী! আপনি তাদের বলে দিন, দুনিয়ার নাজ-নেয়ামত অতি সামান্য (সূরা নিসা : ৭৭)। এটা ভালোবাসার নিদর্শন ব্যতীত অন্য কিছু হতে পারে না।
ইমাম রাযী রহ: খুবই বিস্ময়কর কথা বলতেন। একবার তিনি বললেন, হে আল্লাহ! তোমার স্মরণ ব্যতীত দিন ভালো লাগে না, তোমার সাথে কথোপকথন ব্যতীত রাত ভালো লাগে না। কী আশ্চর্যজনক সম্পর্কই না তারা আল্লাহর সাথে গড়ে তুলেছিলেন। আল্লাহর ভালোবাসা এমন যেটা আত্মার খোরাক ও চোখে প্রশান্তি তৈরি করে। যে তা হারিয়ে ফেলে সে যেন সমুদ্রের গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকে। আল্লাহর ভালোবাসাই ঈমান ও আমলের প্রাণসত্তা। আল্লাহকে কেন ভালোবাস না! ভালোবাসার সমস্ত রসদ তো তার কাছেই রয়েছে। মানুষ মূলত কাউকে ভালোবাসে তার রূপ-সৌন্দর্য, যোগ্যতা-দক্ষতা ও সম্পদের প্রাচুর্যের কারণে। অথচ আল্লাহর মাঝে এসব গুণই বিদ্যমান। কেননা হাদিসে কুদসিতে আছে- আল্লাহ সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্যকে ভালোবাসেন। যোগ্যতা ও দক্ষতার কথা বলতে গেলে তিনি নিজেই বলেছেন, হে নবী, আপনি বলে দিন, যদি পৃথিবীর সমস্ত সমুদ্রের পানিগুলোকে কালি বানানো হয় এবং তা দিয়ে আপনার রবের প্রশংসা লেখা শুরু করা হয়। তাহলে কালি ফুরিয়ে যাবে; কিন্তু আপনার বিধাতার প্রশংসাবাক্য লেখা ফুরাবে না (সূরা কাহাফ : ১০৯)।
আর সম্পদের কথা বলতে গেলে বলতে হবে, মানুষ হলো অনুগ্রহের দাস। আমাদের কাছে নিজস্ব কিছুই নেই। সবই সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ।
আল্লাহর ভালোবাসা তৈরির জন্য অধিক পরিমাণে জিকির করা উচিত। কেননা ঐশীগ্রন্থ আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- তোমরা অধিক পরিমাণে আল্লাহর জিকির করো (সূরা আহযাব : ৪১)।
এতে করে আল্লাহর সাথে গভীর সুসম্পর্ক তৈরি হবে। সব কিছুর উপর আল্লাহকে প্রাধান্য দিয়ে তার গুণসমূহের কল্পনায় বিভোর থাকতে হবে। অধিক পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত করার মাধ্যমে আল্লাহকে পাওয়া সম্ভব। আর কুরআন তিলাওয়াত করা মানে আল্লাহর সঙ্গে কথা বলা। ইরশাদ হচ্ছে, দয়াময় আল্লাহ কুরআন শেখানোর নিমিত্তে মানব সৃষ্টি করলেন, তাকে ভাব প্রকাশ শেখালেন (সূরা-৫৫ রহমান : ১-৪)।
বেশি বেশি নফল নামাজ পড়তে হবে। কারণ রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, তুমি আল্লাহর জন্য বেশি বেশি সিজদা করবে (অর্থাৎ বেশি বেশি নফল নামাজ পড়বে) কারণ তুমি যখনই আল্লাহর জন্য একটি সিজদা করো, তখনই তার বিনিময়ে আল্লাহ তোমার একটি মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং তোমার একটি পাপ মোচন করেন (মুসলিম : ১/৩৫৩)।
সুন্নতের পরিপূর্ণ অনুসরণ করত যাবতীয় কুসংস্কার থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- যে রাসূলের আনুগত্য করল, সে অবশ্যই আল্লাহর আনুগত্য করল (সূরা নিসা : ৮০)।
উদাসীনতার চাদরকে গুটিয়ে রেখে নির্জনে আল্লাহর সাথে সময় কাটানোর চেষ্টা করতে হবে। তার সৃষ্টিসমূহ উপলব্ধি করতে হবে। মূলত আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে অন্য সব কিছু ব্যতিরেকে আল্লাহকেই চাওয়া উচিত। প্রবৃত্তির চাহিদাগুলো জলাঞ্জলি দিয়ে আল্লাহর ইচ্ছেগুলোকে প্রাধান্য দেয়া উচিত। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সামনে দণ্ডায়মান হওয়াকে ভয় করে এবং প্রবৃত্তির চাহিদা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখে, তার ঠিকানা হবে জান্নাত (সূরা নাজিয়াত : ৪০-৪১)।