বঙ্গনিউজবিডি ডেস্ক: সংকটে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংককে এবার বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক বা ইউসিবির সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার (৯ মার্চ) ইউসিবি ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে ডেকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে ইউসিবি ব্যাংকের পর্ষদের একজন সদস্য ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে বৈঠক করেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্রটি জানায়, বৈঠকে ন্যাশনাল ব্যাংকের কেউ উপস্থিত ছিলেন না। তাঁদের অনুপস্থিতিতেই ইউসিবিকে ব্যাংকটি একীভূত করার বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়। ন্যাশনাল ব্যাংককে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এখনো কিছু জানানো না হলেও ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদে এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছিল বেশ কিছুদিন ধরে। ব্যাংকটিতে নিযুক্ত স্বতন্ত্র পরিচালকেরা চান, এটিকে অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করতে। তবে শেয়ারধারী পরিচালকেরা আরও কিছু সময় অপেক্ষা করে আর্থিক অবস্থার উন্নতি করা যায় কি না, তা দেখতে চান। এ নিয়ে ব্যাংকটির পর্ষদ দ্বিধাবিভক্ত।
একীভূত হওয়া নিয়ে ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদ দ্বিধাবিভক্ত হলেও সরকার চাচ্ছে এটিকে একীভূত করতে। এ জন্য ইউসিবি ব্যাংককে এগিয়ে আসার প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে কোনো পক্ষই আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো কথা বলতে রাজি হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে ইউসিবি ব্যাংকের মালিকানার সঙ্গে যুক্ত একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রথম আলো। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আমাদের (ইউসিবি) প্রস্তাব করা হয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংককে একীভূত করার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে। আমরা এ বিষয়ে কী করা যায়, সেটি দেখব। ন্যাশনাল ব্যাংকের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে আমাদের পর্ষদ এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।’
এ নিয়ে গত এক মাসে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১০টি ব্যাংকের একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সর্বশেষ ইউসিবি ও ন্যাশনাল ব্যাংকের একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর আগে গত সোমবার বেসরকারি সিটি ব্যাংকের সঙ্গে সরকারি মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়। ওই দিন সিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিকে ডেকে এ সিদ্ধান্তের কথা জানান গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। ওই বৈঠকেও বেসিক ব্যাংকের কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। আজও ন্যাশনাল ব্যাংক একীভূত করার বিষয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকেও ন্যাশনাল ব্যাংকের কোনো প্রতিনিধি ছিলেন না বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়।
গত ডিসেম্বরে আর্থিক নানা অনিয়মের কারণে সংকটে পড়া সিকদার গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে নতুন পর্ষদ গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের আদেশে ব্যাংকটির পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়।
গভর্নরের আদেশে বলা হয়েছিল, ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ঋণের নিয়ম ও বিধিবিধান লঙ্ঘন করে ঋণ অনুমোদন, ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ, ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যাংকের শেয়ার একই পরিবারে কেন্দ্রীভূত করা, পরিচালক নির্বাচন বা পুনর্নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি, পর্ষদের গোচরে আর্থিক অনিয়ম সংঘটন, পর্ষদের নীতিনির্ধারণী দুর্বলতার কারণে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার অবনতি, ব্যাংকিং সুশাসন ও শৃঙ্খলা বিঘ্ন করার মাধ্যমে ব্যাংক-কোম্পানি ও আমানতকারীদের স্বার্থের পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে পর্ষদের সম্পৃক্ত থাকার ঘটনা ঘটেছে। এ জন্য বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সুপারিশে আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষা ও জনস্বার্থে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করা হলো।
ব্যাংকটির পর্ষদ থেকে মনোয়ারা সিকদার, রন হক সিকদার, রিক হক সিকদার, নাইমুজ্জামান ভূঁইয়া ও মুরশিদ কুলি খানকে বাদ দেওয়া হয়। তাঁদের বদলে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম ও সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম কামাল হোসেনকে। এর বাইরে শেয়ারধারীদের মধ্য থেকে পরিচালক করা হয় পারভীন হক সিকদার, উদ্যোক্তা পরিচালক খলিলুর রহমান, সিকদার ইনস্যুরেন্স কোম্পানির পক্ষে প্রতিনিধি পরিচালক মো. সফিকুর রহমান ও উদ্যোক্তা শেয়ারধারী পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১১ হাজার ৭২০ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের প্রায় ২৯ শতাংশ। আর গত বছর শেষে ব্যাংকটির নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশনিং ঘাটতি ছিল প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। একই সময়ে বেসরকারি খাতের ইউসিবির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির বিতরণ করা মোট ঋণের ৫ শতাংশ।
এদিকে এখন পর্যন্ত যে ১০টি ব্যাংকের একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে, তার মধ্যে ৫টি সরকারি ব্যাংক ও ৫টি বেসরকারি ব্যাংক। সরকারি যে ৫টি ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে সোনালী ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা বিডিবিএল, কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক। এর মধ্যে সোনালীর সঙ্গে বিডিবিএল, কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক বা রাকাবের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর বেসরকারি যে ৫টি ব্যাংকের একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে এক্সিম ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ইউসিবি, ন্যাশনাল ও পদ্মা ব্যাংক। এর মধ্যে এক্সিমের সঙ্গে পদ্মা, ইউসিবির সঙ্গে ন্যাশনাল ও সিটির সঙ্গে সরকারি মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলো সবল বা ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে।