মতবিনিময়ে অংশ নেওয়া প্রায় সব ছাত্রসংগঠনের নেতারা ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের পরিবর্তে প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং ছাত্র সংসদ কার্যকর করার দাবি জানান।
সভার দুই পর্বে ছাত্রসংগঠনগুলোর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন দাবিদাওয়া ও প্রস্তাব তুলে ধরেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতিসহ সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে—এমন আলোচনা সামনে আসার পর আজ ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খানের কার্যালয়ে এই সভায় দুই সহ–উপাচার্য মামুন আহমেদ ও সায়মা হক বিদিশা, কোষাধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেন।
বেলা সাড়ে ১১টা থেকে সোয়া ১টা পর্যন্ত প্রথম পর্বে আলোচনায় অংশ নেয় ইসলামী ছাত্রশিবির, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল ও বিপ্লবী ছাত্র–যুব আন্দোলন। বেলা দুইটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত আলোচনায় অংশ নেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী), সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (বাসদ), ছাত্র ফেডারেশন, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী ও ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।
জানতে চাইলে উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘সব ছাত্রসংগঠনের কথাগুলো শুনলাম। আমাদের মূল অগ্রাধিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক করা। সেটিকে সামনে রেখেই সবার সঙ্গে বসলাম।’
ছাত্রদল যা বলল
বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় ও সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন আলোচনায় অংশ নেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সিন্ডিকেটকে ‘খুনি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার প্রতিনিধিত্বকারী দালালদের সিন্ডিকেট’ আখ্যা দিয়ে তা ভেঙে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
সভা শেষে গণেশ চন্দ্র সাংবাদিকদের বলেন, শিক্ষার্থীদের ভাবাবেগ (সেন্টিমেন্ট) ধারণ করেই রাজনীতি পরিচালিত হবে। বিগত ১৫ বছরের যে নির্যাতনের আতঙ্ক (ট্রমা) ছাত্রলীগ গেস্টরুম ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে তৈরি করেছে, সেটাকেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ ছাত্ররাজনীতি বলে মনে করছেন। এই ট্রমা কাটতে সময় লাগবে। ফ্যাসিস্টদের নির্মিত এই ট্রমা নিবারণে কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগের রাজনীতি যে ছাত্ররাজনীতি নয়, তা সাধারণ শিক্ষার্থীদের বুঝতে হবে। ক্যাম্পাসে ভয়মুক্ত ও শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, সে বিষয়ে সভায় আলোচনা হয়েছে। আমরা চাই, রাজনীতি হবে মেধা ও শিক্ষার্থীদের চাওয়ার ভিত্তিতে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা একটি চরিত্র রয়েছে উল্লেখ করে নাহিদুজ্জামান বলেন, সেই চরিত্র রাজনীতিবিমুখ বা রাজনীতির বাইরে নয়। ফ্যাসিবাদ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে ভয় ও শঙ্কামুক্ত ছাত্ররাজনীতি নিয়ে সভায় আলোচনা হয়েছে। সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। আগামীকাল ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম চালু হতে যাচ্ছে। সবাই কীভাবে একত্র হয়ে কাজ করবেন, সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
নাহিদ আরও বলেন, ‘প্রশাসন আমাদের বলেছে, ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। পরিবর্তিত অবস্থায় ছাত্ররাজনীতির গুণগত পরিবর্তন করতে হবে। সেটি কীভাবে হবে, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।’
সংলাপ চায় শিবির
সভায় সব ছাত্রসংগঠনকে নিয়ে একটি সংলাপের আয়োজন করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ছাত্রশিবির। শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সাদিক কায়েম বলেন, সভায় তাঁরা বলেছেন, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা কোনো প্রাজ্ঞ সিদ্ধান্ত নয়। তাঁরা উপাচার্যের কাছে ছাত্ররাজনীতির সংস্কার চেয়েছেন।
সাদিক কায়েম বলেন, ‘আমরা সব ছাত্রসংগঠনকে নিয়ে একটি সংলাপের আয়োজন করতে বলেছি, যেখানে শুধু ফ্যাসিবাদের দোসর ছাড়া সব ছাত্রসংগঠন আসবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন খুব দ্রুতই সংলাপ আয়োজন করার কথা বলেছে। সেই সংলাপ এবং শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশার আলোকে তাঁরা একটা সিদ্ধান্তে আসবেন।’
সাদিক আরও বলেন, ‘ছাত্রলীগ ও ১৪ দলভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্রসংগঠন—এরা ফ্যাসিবাদের দোসর। তাদের রাজনীতি করার অধিকার নেই। তারা বাদে বাকি সব সংগঠনের কনসেনসাসের (ঐকমত্য) ভিত্তিতে আমরা সুস্থ ধারার ছাত্ররাজনীতি করতে চাই।’
এদিকে ছাত্রশিবিরকে সভায় ডাকা নিয়ে এবং ১৯৯০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদের চুক্তি বাতিল হয়ে গেল কি না, সে বিষয়ে সভায় প্রশ্ন তোলেন ছাত্র ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক মাঈন আহমেদ। তবে উপাচার্য এ বিষয়ে কোনো উত্তর দেননি বলে জানান তিনি। শিবিরসহ ধর্মীয় সংগঠনকে সভায় ডাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ছাত্র ফ্রন্টের (বাসদ) বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা সোহাইল আহমেদও।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্তত ১৭ বছর পর ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করল।
আরও যত দাবি–প্রস্তাব
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্বায়ত্তশাসিত সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কারের আলোচনা এগিয়ে নিতে অংশীজনদের নিয়ে কনভেনশন করার প্রস্তাব দেন ছাত্র ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক মাঈন আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংবিধান অনুসারে ছাত্ররাজনীতি থাকবে কি থাকবে না, তা বিতর্কের বিষয় হতে পারে না। সেটি আমরা বলেছি। ছাত্ররাজনীতির নামে যে অপকর্মগুলো হয়েছে, সেগুলো ঠেকানোর জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত।
প্রশাসন এ বিষয়গুলো কীভাবে আটকাবে, কীভাবে শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করা হবে, সে বিষয়ে প্রতিরোধমূলক আইন বা নীতিমালা হতে পারে। এ ছাড়া একাডেমিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, আগের সরকারের সময়ে প্রণীত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত মহাপরিকল্পনা পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছি।’
ছাত্র ফ্রন্টের নেতা সোহাইল আহমেদ সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদ কার্যকর করা, হলগুলোতে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ এবং সন্ত্রাস–দখলদারত্বের বিষয়টি নজরদারি করতে হল পর্যায়ে ও কেন্দ্রীয়ভাবে সেল গঠনের দাবি জানান।
পেশিশক্তি ও দখলদারত্বের রাজনীতি বন্ধ করার দাবি জানান ছাত্র ফেডারেশনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আরমানুল হক। তিনি বলেন, ‘আমরা রাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষে নই, যৌক্তিক সংস্কার চেয়েছি।’