এম এ হোসেইন ইউকে থেকে : খাদ্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিকের উপস্থিতি বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম বড় জনস্বাস্থ্য সংকট। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাজারে সহজলভ্য প্রায় সব খাদ্যেই কোনো না কোনো ক্ষতিকর রাসায়নিক মেশানো হয়। এটি শরীরে ধীরে ধীরে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে, যার ফলে ক্যান্সার, কিডনি বিকল হওয়া, লিভার সমস্যা, হরমোনজনিত অসুস্থতা ও নানা জটিল রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশে খাদ্যে ভেজালের ভয়াবহতা
১. শাক-সবজি ও ফলমূল:
✔ কপার সালফেট: শাক-সবজি সতেজ রাখতে ব্যবহার করা হয়, যা কিডনি ও লিভারের ক্ষতি করে।
✔ কার্বাইড ও ফরমালিন: কলা, আম, লিচু, আঙুর, আপেল ইত্যাদি দ্রুত পাকানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। কার্বাইড ক্যান্সারের অন্যতম কারণ।
✔ পটাশিয়াম পারম্যাংগানেট: তরমুজ ও পেঁপের রং আকর্ষণীয় করতে ব্যবহৃত হয়, যা পাকস্থলীতে আলসার সৃষ্টি করতে পারে।
২. চাল, আটা ও ময়দা:
✔ ইউরিয়া সার: চালকে চকচকে সাদা করতে মেশানো হয়, যা কিডনির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
✔ ব্লিচিং পাউডার: আটা ও ময়দাকে দীর্ঘদিন সাদা রাখতে ব্যবহৃত হয়, যা ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে।
৩. মাছ-মাংস ও ডিম:
✔ ফরমালিন: মাছ ও মাংস সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয়, যা মানবদেহে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে।
✔ অ্যান্টিবায়োটিক ও হরমোন: ব্রয়লার মুরগিকে দ্রুত বড় করার জন্য অতিরিক্ত ওষুধ দেওয়া হয়, যা মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
৪. দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য:
✔ স্টেরয়েড ইনজেকশন: গরুর দুধ উৎপাদন বাড়াতে নিষিদ্ধ স্টেরয়েড দেওয়া হয়, যা শিশুদের হরমোন ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।
✔ সিন্থেটিক দুধ: বাজারে প্রচুর কৃত্রিম দুধ পাওয়া যায়, যেখানে ইউরিয়া ও ডিটারজেন্ট মেশানো হয়।
৫. রান্নার তেল ও মসলা:
✔ পাম অয়েল মেশানো সয়াবিন তেল: অতিরিক্ত ব্যবহারে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে।
✔ সীসা (Lead) ও ক্রোমিয়াম: হলুদ ও মরিচের গুঁড়ায় মেশানো হয়, যা স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করে।
৬. মিষ্টি ও বেকারি খাবার:
✔ পোড়া মবিল ও রং: জিলাপি ও মিষ্টিতে ব্যবহৃত হয়, যা ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
✔ সিন্থেটিক চিনি ও কৃত্রিম মিষ্টি: দীর্ঘদিন ব্যবহারে ডায়াবেটিস ও হরমোনজনিত সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়।
৭. সফট ড্রিংকস ও জুস:
✔ কৃত্রিম রং ও ক্যামিকেল: শরবত, রুহ আফজা, কার্বোনেটেড পানীয়তে ব্যবহার করা হয়, যা কিডনি ও লিভারের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে করণীয়
✅ ১. সচেতনতা বৃদ্ধি: জনগণের মধ্যে খাদ্যে ভেজালের ভয়াবহতা সম্পর্কে প্রচার করতে হবে।
✅ ২. নিজস্ব অর্গানিক খাবার উৎপাদন: ছাদ বাগান বা নিজস্ব কৃষিকাজে রাসায়নিক মুক্ত খাবার উৎপাদন করা যেতে পারে।
✅ ৩. রাসায়নিক মুক্ত খাবার চিহ্নিত করা: বাজার থেকে কেনার আগে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে কেনা উচিত।
✅ ৪. সরকারি নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি: খাদ্য অধিদপ্তর ও বিএসটিআইকে কঠোর নজরদারি চালাতে হবে।
✅ ৫. গবেষণা ও উদ্ভাবন: কীভাবে সহজে ও কম খরচে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করা যায়, সে বিষয়ে গবেষণার প্রয়োজন।
✅ ৬. আইনের কঠোর প্রয়োগ: যারা খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে জনগণের জীবন নিয়ে খেলছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
সুস্থ থাকতে যে খাবার খাবেন
✔ অর্গানিক শাক-সবজি ও ফলমূল
✔ গৃহপালিত দেশি মুরগি ও গরুর মাংস
✔ বিশুদ্ধ পানি ও ভেষজ পানীয়
✔ প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষিত খাবার (কোনো কৃত্রিম সংরক্ষণ ছাড়া)
✔ কেমিকেলমুক্ত চাল, ডাল ও ময়দা
✔ খাঁটি সরিষার তেল, নারকেল তেল ও ঘি
উপসংহার:
খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ করা শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, এটি আমাদের সবার দায়িত্ব। সচেতন হলে এবং নিরাপদ খাদ্য বেছে নিলে আমরা সুস্থ জীবনযাপন করতে পারব। খাদ্যে ভেজাল বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি একান্ত জরুরি।
“খাদ্যে ভেজালমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে আসুন সবাই একসাথে কাজ করি।”