বঙ্গনিউজবিডি ডেস্ক : ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির পাশে দাঁড়ানো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কিংবদন্তী সাংবাদিক সাইমন ড্রিং মারা গেছেন। এ দেশের আধুনিক টিভি সাংবাদিকতার পথিকৃত ছিলেন তিনি । গত শুক্রবার তিনি মারা যান।
লন্ডন থেকে সাংবাদিক সৈয়দ নাহাস পাশা তার নিজ ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া একটি স্ট্যাটাস এ তথ্য জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন নানা দেশের অজস্র সহমর্মী মানুষ। তাদের কেউ কেউ ভূমিকা রেখেছিলেন রাইফেল কাঁধে যুদ্ধের মাঠে, শরণার্থী শিবিরে, কেউবা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন বিভিন্নভাবে প্রতিবাদ ও জনমত গঠন করে। কঠিন সেই সময়ে তাঁরা যে ভূমিকা রেখেছেন নিঃসন্দেহে তা অবিস্মরণীয়। তেমনি একজন ‘সাহসী যোদ্ধা’ ছিলেন সাইমন ড্রিং।
বিলাতি দৈনিক দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর রিপোর্টার সাইমন ড্রিং কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে কাজ করছেন। লন্ডনের সদর দপ্তর থেকে ফোন করে তাঁকে বলা হলো, ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত। সেখানে বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে, তুমি ঢাকা যাও।’ সাইমন অনেক বছর ধরে সাংবাদিকতা করছিলেন লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম অঞ্চলে। পাকিস্তান বা পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণাই ছিল না। তবু তিনি মার্চের ৬ তারিখে কম্বোডিয়া থেকে ঢাকায় এলেন। পরদিন ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণটি প্রত্যক্ষ করলেন। একটি বাংলা শব্দও তাঁর বোধগম্য ছিল না, কিন্তু লাখ লাখ জনতার প্রতিক্রিয়া, তাদের চোখমুখের অভিব্যক্তি দেখে অনুভব করলেন, তিনি উপস্থিত হয়েছেন বিরাট এক রাজনৈতিক ঘটনার মধ্যে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ভীষণ বিক্ষুব্ধ, তারা ‘জয় বাংলা’ চায়। সংকল্প ও আশায় উদ্দীপিত চোখে তারা চেয়ে আছে শেখ মুজিবের দিকে।
সপ্তাহখানেকের জন্য ঢাকা এসে সাইমন ড্রিং ফিরে যাওয়ার কথা আর ভাবতেই পারলেন না। পাকিস্তানের রাজনীতি ও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আন্দোলন–সংগ্রাম সম্পর্কে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা শুরু হলো। শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হলো। সখ্য গড়ে উঠল অনেকের সঙ্গে। সর্বশেষ রাজনৈতিক ঘটনাবলি নিয়ে তিনি নিয়মিত প্রতিবেদন পাঠাতে লাগলেন লন্ডনে।
সাইমন উঠেছিলেন ঢাকার শাহবাগে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী হত্যাযজ্ঞ শুরু করার আগেই ঢাকায় সে সময় অবস্থানরত সব বিদেশি সাংবাদিককে ওই হোটেলে অবরুদ্ধ করে ফেলে। সেনা কর্তৃপক্ষ তাঁদের বলে, শহরের পরিস্থিতি খুব খারাপ, নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁদের হোটেলের ভেতরেই অবস্থান করতে হবে। অবরুদ্ধ বিদেশি সাংবাদিকেরা সারা রাত গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান, কেউ কেউ জানালা দিয়ে দেখতে পান আগুন। পরদিন সকালেই তাঁদের বিমানবন্দরে নিয়ে তুলে দেওয়া হয় উড়োজাহাজে।
কিন্তু পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ সাইমন ড্রিংকে খুঁজে পায়নি। তিনি প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে হোটেলেই লুকিয়ে ছিলেন। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ উঠে গেলে হোটেলের কর্মচারীদের সহযোগিতায় ছোট্ট একটি মোটরভ্যানে করে ঘুরে ঘুরে দেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা। তারপর লেখেন ‘ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’ শিরোনামের এক প্রতিবেদন, ‘আল্লাহর নামে আর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও সন্ত্রস্ত এক নগর। পাকিস্তানি সৈন্যদের ঠান্ডা মাথায় টানা ২৪ ঘণ্টা গোলাবর্ষণের পর এ নগরের…।’
ঢাকায় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো প্রথম দফার গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রত্যক্ষ চিত্র উঠে আসে ওই প্রতিবেদনে। লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ৩০ মার্চ সেটা ছাপা হয়। এই প্রতিবেদন থেকেই বিশ্ববাসী জানতে পারে পাকিস্তানি বাহিনীর সেদিনের বর্বরতার কথা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত সঞ্চারের প্রাথমিক মুহূর্ত ছিল সেটি।
৩০ মার্চ সাইমনকে লন্ডন চলে যেতে হয়। তারপর কলকাতায় আসেন নভেম্বরে; সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দিতেন লন্ডনের টেলিগ্রাফ পত্রিকায়। ১৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ট্যাংকে চড়ে ময়মনসিংহ হয়ে প্রবেশ করেন মুক্ত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়।
১৬ ডিসেম্বরের পর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল সাইমনের। সাইমন তাঁকে জানান, ২৫ মার্চ বিদেশি সাংবাদিকদের বের করে দেওয়ার সময় তিনি লুকিয়ে থেকে গিয়েছিলেন। এরপর প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আমাকে খুঁজে পেলে তোমরা কী করতে?’ সিদ্দিক সালিক বলেছিলেন, ‘গুলি করে মারা হতো।’
সাইমন ড্রিং স্বাধীন বাংলাদেশে আবার এসেছিলেন ২০০০ সালে; এ দেশের প্রথম বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টিভি গড়ে তোলার প্রধান কারিগর হিসেবে। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর একুশে টিভি বন্ধ করে দেয়। ২০০২ সালের অক্টোবরে সরকার সাইমন ড্রিংয়ের ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করে তাঁকে অবিলম্বে বাংলাদেশ ত্যাগের আদেশ দিলে তিনি চলে যান।
সাইমন ড্রিংয়ের জন্ম ইংল্যান্ডে, ১৯৪৫ সালে। তিনি সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন ১৮ বছর বয়স থেকে। দেখেছেন ২২টি যুদ্ধ, অভ্যুত্থান ও বিপ্লব। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনবাসী। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল আমাদের প্রকৃত সহযোদ্ধার।
এখন তিনি তার আইনজীবী এবং মানবাধিকার কর্মী স্ত্রী ফিয়ানা ম্যাকফারসন এবং যমজ কন্যা ইভা এবং ইন্ডিয়া রোজের সাথে অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে বসবাস করছেন। তার প্রথম স্ত্রীর ঘরে তানিয়া নামে আরও একটি কন্যা রয়েছে যিনি এখন স্পেনে থাকেন।
তিনি দ্য সানডে, টাইমস, নিউজউইক এবং বিবিসি রেডিও নিউজের একজন ফ্রিল্যান্স প্রতিবেদক এবং প্রযোজকও ছিলেন। বছরের পর বছর ধরে ড্রিং ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ইরান, নাইজেরিয়া, অ্যাঙ্গোলা, উগান্ডা, ইরিত্রিয়া, সাইপ্রাস, ইসরায়েল সহ ইউরোপ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকার অনেক দেশের বড় বড় ইভেন্ট কাভার করেন।
যুদ্ধক্ষেত্রে কাজ করার সময় সাইমন ড্রিং দু’বার আহত হন- প্রথমবার ভিয়েতনামে, এবং দ্বিতীয়বার সাইপ্রাসে। সাংবাদিক হিসেবে তার আলোকিত ক্যারিয়ার অসংখ্য মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার এবং সম্মাননায় ভরপুর। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকার গণহত্যার ডেইলি টেলিগ্রাফে প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণীর জন্য ইউকে রিপোর্টার অভ দ্য ইয়ার হয়েছিলেন।
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় অসাধারণ ভূমিকার জন্য সাইমন ড্রিংয়ের প্রতি কৃতজ্ঞ আজ পুরো বাংলাদেশ।