কিন্তু দীর্ঘদিন পার হয়ে গেলেও পিয়াসা মালিকানা বদলের আবেদন না করার ফলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সার্ভারে আগের মালিকের প্রতিষ্ঠানের নামই থেকে গেছে। সে কারণে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে এবং গণমাধ্যমের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও ঘুরপাক খেতে হয়েছে তা নিয়ে।
বিএমডব্লিউ গাড়িটির মালিকানা পরিবর্তনের ব্যাপারে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে আবেদন করেন পিয়াসা। গাড়িটি গত মাসে বিআরটিএতে পিয়াসার নামে রেজিস্ট্রেশন করা হলেও করোনাভাইরাস মহামারির কারণে চলা লকডাউনের জেরে সার্ভারে আপডেট করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
পিয়াসা গাড়ি কেনার পর কেন দীর্ঘ সময়েও মালিকানা পরিবর্তনের আবেদন করেননি, তা নিয়ে সন্দিহান বিআরটিএর কর্মকর্তাদের পাশাপাশি গাড়িটির আগের মালিকপক্ষও।
বিআরটিএর সার্ভারে পিয়াসার ব্যবহৃত বিএমডব্লিউ এস২০৯ মডেলের সিলভার রঙের গাড়িটির নিবন্ধন এখনো দ্য রিলায়েবল বিল্ডার্সের নামে।
জানা গেছে, ওরিয়েন্ট ট্রেডিং অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান দ্য রিলায়েবল বিল্ডার্স। প্রতিষ্ঠানটির মালিক শফিকুল আলম মিথুন।
দ্য রিলায়েবল বিল্ডার্সের মালিক শফিকুল আলম মিথুন বলেন, ঢাকা মেট্রো-গ-৩৯-৮৫৭৪ নম্বরের বিএমডব্লিউ আমারই ছিল। ২০১৮ সালে গাড়িটি আমি এঅ্যান্ডএ কার সেন্টারের কাছে বিক্রি করেছি। ট্যাক্সফাইল থেকেও গাড়িটা আমি রিডাকশন করে দিয়েছি। এঅ্যান্ডএ মূলত পুরনো গাড়ি বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত। তারা বিক্রি করেছে মিস্টার মানাম সাহেবের কাছে, আমারই ছোট ভাই ওটিবিএল-এর ডিরেক্টর।
তিনি আরো বলেন, মানাম সাহেব গাড়িটা বিক্রি করেছে নিড ফোর স্পিডের কাছে ২০১৯ সালে। নিড ফোর স্পিড নাকি গাড়িটি বিক্রি করেছে পিয়াসার কাছে। নিড ফোর স্পিডও পিয়াসার নামে বিআরটিএ-তে গাড়ির নাম ট্রান্সফার করে দিয়েছে।
তিনি আরো বলেন, পিয়াসার গাড়ি জব্দ হওয়ার পরই একবার সন্দেহ হয়েছিল। বুধবার গাড়িটি নিয়ে খবর প্রকাশের পর জানতে পারি- গাড়িটি এখনো আমার প্রতিষ্ঠানের নামেই আছে।
শফিকুল আলম মিথুনের ছোট ভাই মানাম বলেন, ভাইয়ার কাছ থেকে গাড়িটি নিয়ে আমি দুই বছর ব্যবহার করি। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে বারিধারার ৭১ প্রগতি সরণিতে অবস্থিত নিড ফোর স্পিড নামের একটি গাড়ির দোকানে এটি বিক্রি করে একটি পাজেরো কিনি।
তিনি আরো বলেন, সেই ক্রয়-বিক্রয়ের কাগজপত্রও আমার কাছে আছে। এরপর আমি আর কিছু জানি না। হঠাৎ পিয়াসাকে গ্রেপ্তারের পর আমার সেই পুরোনো গাড়ি দেখে আঁতকে উঠি। তখনো ভাবিনি বিআরটিএতে গাড়িটি আমাদের নামেই আছে। গাড়িটির বর্তমান মালিকানার তথ্য আপডেট হয়নি। আমরা তো অনেক আগেই নাম পরিবর্তনের কাজ সেরে ফেলেছি। বিআরটিএতে গাড়িটির মালিকানায় এখনও আমাদের নাম কেন আছে বুঝতে পারছি না।
নিড ফোর স্পিডের মালিক আতিক রহমান খান বলেন, পিয়াসাকে বিআরটিএ থেকে নাম পরিবর্তনের জন্য বারবার চাপ দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছিল না। একপর্যায়ে ফোনে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন তিনি।
নিড ফোর স্পিডের মালিক আতিক আরো বলেন, আমরা মূলত পুরনো গাড়ি বেচাকেনার ব্যবসা করতাম, কিন্তু করোনার কারণে আমাদের ব্যবসায় চরম ক্ষতি হয়। তাই গাড়ির ব্যবসা বন্ধ করে অন্য ব্যবসা শুরু করেছি।
পিয়াসার বিএমডব্লিউ-এর ব্যাপারে তিনি বলেন, এটা এক বছর আগের কথা। সম্ভবত ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে রিফাত বিন আলম নামের একজনের কাছ থেকে আমরা ঢাকা মেট্রো-গ-৩৯-৮৫৭৪ নম্বরের বিএমডব্লিউ এস২০৯ মডেলের সিলভার রঙের একটি গাড়ি এক্সচেঞ্জ করি।
তিনি আরো বলেন, কাগজে-কলমে আমরা তাদের কাছ থেকে একটি বিএমডব্লিউ গাড়ি কিনে আরেকটি পাজেরো গাড়ি তাদের কাছে বিক্রি করি। সে সময়ে রিফাত বিন আলমের সঙ্গে আমরা ১০০ টাকার স্ট্যাম্পে গাড়ি বিক্রির চুক্তিনামাও করি।
আতিক বলেন, আমরা এই বিএমডব্লিউ কেনার কয়েক দিনের মধ্যেই পিয়াসা নামের মেয়েটি লকডাউনের মধ্যেই আমাদের কাছ থেকে গাড়িটি কিনে নেয়। তার কাছে গাড়ি বিক্রির সেই কাগজপত্রও আমাদের কাছে আছে। তখন আমরা পিয়াসাকে বিআরটিএ থেকে নাম পরিবর্তনের জন্য তেমন চাপ দিইনি। কারণ তখন লকডাউন চলছিল।
তিনি আরো বলেন, লকডাউন শেষ হলে আমরা পিয়াসাকে চাপ দিতে থাকি, আপনি বিআরটিএ থেকে নাম পরিবর্তন করে নেন। সে আজ করছি, কাল করছি বলে ঘোরাতে থাকে। একটা সময় সে আমাদের ফোন ধরাই বন্ধ করে দেয়। পরে ফোন ধরলেও লকডাউনের দোহাই দিতে থাকে। আমাদের চাপাচাপিতেই এ বছরের এপ্রিল মাসে পিয়াসা বিআরটিএতে আবেদন করে। জুলাই মাসে নাম পরিবর্তন হয়। সেই পরিবর্তনের একটা কপি আমরা রাখি, আরেকটা কপি যিনি মূল বিক্রেতা তাকে দিই।
তিনি আরো বলেন, এরপর আমরা বিআরটিএতে কথা বলে আপডেট করতে বলি। যেহেতু আমাদের টাকাপয়সা জমা দেয়া আছে, সব কাগজ আপডেট করা আছে। তখন বিআরটিএ থেকে আমাদের জানানো হয়, লকডাউন চললে তাদের সার্ভারও বন্ধ থাকে। তাই লকডাউন উঠে গেলে তারা গাড়ির নাম পরিবর্তন আপডেট করে দেবে। অথচ এই লকডাউনের মধ্যেই এই গাড়ি নিয়ে এত কিছু হয়ে গেল।
গাড়িটির মালিকানা পরিবর্তন সংক্রান্ত বিআরটিএর একটি অনুলিপিতে দেখা যায়, ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা গত ১২ এপ্রিল ঢাকা মেট্রো-গ-৩৯-৮৫৭৪ নম্বরের বিএমডব্লিউ গাড়িটির মালিকানা পরবর্তনের আবেদন করেন। আবেদনে রেজিস্ট্রেশন কর্তৃপক্ষ সই করে ১২ জুলাই। আবেদনে পিয়াসা তার বনানীর বাসার ঠিকানা ব্যবহার করেন। বাবার নাম মাহবুব আলম উল্লেখ করেন।
বিআরটিএর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, আমাদের সার্ভারে এখনো ঢাকা মেট্রো-গ-৩৯-৮৫৭৪ নম্বরের বিএমডব্লিউ গাড়িটি দ্য রিলায়েবল বিল্ডার্স নামেই নিবন্ধিত আছে। ২০২০ সালে এটার মালিকানা পরিবর্তন হওয়ার পরেও যদি আমাদের কাছে আসতে এত দিন লাগে, তাহলে বলতে হবে এর জন্য দায়ী তিনি, যিনি গাড়িটি কিনেছেন। কোনো অনিয়ম হলে সেটা পিয়াসা করেছেন। কারণ এতদিন নাম পরিবর্তন না করে তিনি বেআইনি কাজ করেছেন।
তিনি আরো বলেন, করোনায় আমাদের কার্যক্রম সীমিত আকারে চলছে। লকডাউনে অফিস বন্ধ থাকে। অফিস বন্ধ থাকলে আমাদের সার্ভারেও কোনো কিছু আপডেট করা হয় না।