সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং জাতীয় সংসদের সাবেক বিরোধী দলীয় নেতা পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ আজকের এই তারিখটিতে অর্থাৎ ১৪ জুলাই ২০১৯ (রবিবার) ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচে) ১৭ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর সকাল পৌনে আটটার দিকে সকলকে কাঁদিয়ে পাড়ি দেন অনন্ত অসীম সেই জগতের উদ্দেশ্যে, যেখান থেকে আর ফিরে আসবেন না তিনি (ইন্না লিল্লাহি…..রাজিউন)।
এরশাদ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩০ সালের ২০ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার জেলায়। বাবা মকবুল হোসেন ও মা মজিদা খাতুনের চার ছেলে ও পাঁচ মেয়ের মধ্যে এরশাদ ছিলেন দ্বিতীয়। অবশ্য ভাইদের মধ্যে সবার বড় ছিলেন তিনি। বাবা-মা আদর করে ‘পেয়ারা’ নামে ডাকতেন সাবেক এই সেনা ও রাষ্ট্রনায়ককে।
এরশাদের স্কুল এবং কলেজ জীবন কেটেছে রংপুর শহরে। ১৯৪৬ সালে কুচবিহারের দিনহাটা হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন করেন তিনি।এরপরে ভর্তি হন রংপুর কারমাইকেল কলেজে। সেখানে পড়ার সময় মনোযোগ দেন লেখালেখির দিকে। ছিলেন কলেজ ছাত্র সংসদের সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক।
বাবা মকবুল হোসেন ছিলেন নামকরা আইনজীবী। এরশাদেরও ইচ্ছা ছিল বাবার মতো বড় আইনজীবী হবেন। ১৯৫০ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকায় আসেন তিনি। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মাত্র দুইশ টাকা নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন এরশাদ। বাবার ওপর চাপ কমাতে নিজেই শুরু করেন টিউশনি। বাবার মত বড় আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ ক্লাসে পড়ার পাশাপাশি ভর্তি হন ল কলেজে।
১৯৪৮ সালে এরশাদ কারমাইকেল কলেজের শ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদ হবার গৌরব অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়েরও ক্রীড়া দলের তিনি ছিলেন কৃতি খেলোয়াড়। ১৯৫৩ থেকে ৫৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা অঞ্চলের ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। ১৯৫২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে এরশাদ কমিশন লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধেও অংশ নেন তিনি। সেনা কর্মকর্তা হিসেবে এরশাদ প্রথম নিয়োগ পান ২ নম্বর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তানের কোয়েটা স্টাফ কলেজ থেকে স্টাফ কোর্স সমাপ্ত করেন। তিনি ১৯৬৭ সালে শিয়ালকোটে ৫৪ ব্রিগেডের ডেপুটি অ্যাসিসটেন্ট অ্যাডজুট্যান্ট ও কোয়াটার মাস্টার জেনারেল ব্রিগেড মেজর ছিলেন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি এরশাদ। ১৯৭৩ সালে ১২ ডিসেম্বর এরশাদ কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি পান। ১৯৭৫ সালের ১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু সরকার উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের দিল্লির ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে পাঠায়। সেখানেই প্রশিক্ষণকালে তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত হন। ওই বছর আগস্ট মাসে আবার পদোন্নতি পেয়ে মেজর জেনারেল হন তিনি। ১৯৭৮ সালের ১ ডিসেম্বর এরশাদ সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৭৯ সালের ৭ নভেম্বর তাকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত করা হয়। ১৯৮০ সালের ৩০ মে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর সেনা বিদ্রোহ দমন করেন এরশাদ।
১৯৮২ সালে ২৪ মার্চ দেশের এক ক্রান্তিকালে তৎতকালীন রাষ্ট্রপতি সাত্তার সরকারের অনুরোধে (সিএমএলএ) হিসেবে রাষ্ট্রের শাসনকাজ শুরু করেন এরশাদ। এরপর ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি গঠন করেন জাতীয় পার্টি। এবং একই বছরে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তারঁ দল জাতীয় পার্টি। বিজয়ী দলের নেতা হিসেবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদ “রাষ্ট্রপতি” র আসনে বসেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। একটানা ৯ বছর বাংলাদেশের নেতৃত্বদেন তিনি। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে তুলে আনেন এক মর্যাদা সম্পূর্ণ দেশ হিসেবে।
১৯৮২ সালে ঘোষিত নতুন শিল্পনীতিকে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগের জন্য আরো উদার করে এরশাদ ১৯৮৬ সালে আরেকটি শিল্পনীতি ঘোষণা করেন। বিশেষত উপজেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা ও গ্রামীন জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে তাঁর অনবদ্য ভূমিকার কারণে এদেশের সাধারণ মানুষ ‘পল্লীবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত করেন রাষ্ট্রপতি এরশাদকে।
১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর মহান সংবিধানকে সংরক্ষণ করে তিনি সেচ্ছায় ক্ষমতা ত্যাগ করেন। ১৯৯১ সালে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ৬ বছর কারান্তরীণ থাকার পর ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি জামিনে মুক্ত হন তিনি। জেলে থাকা অবস্থায় দুই দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে দু’বারই পাঁচটি করে আসনে জয় পান তিনি। ইতিহাস মনে রেখেছে এরশাদের এই বিষ্ময়কর বিজয়কে।
সর্বশেষ ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও সংসদে প্রধান বিরোধী দলে স্হান পায় জাতীয় পার্টি। পল্লীবন্ধু এরশাদ হন বিরোধী দলের নেতা। এবং সেই পদে অধিষ্ঠিত থেকেই নশ্বর এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি দেন বাংলাদেশ তথা বিশ্ব রাজনীতির দূরদর্শী সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। পেয়ার থেকে পল্লীবন্ধু হয়ে উঠা জনতার এরশাদ।
আজ তাঁর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি জাতির শ্রেষ্ঠ
সন্তান পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতি। এবং তাঁর বিদেহী
আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
শ্রদ্ধান্তে,
মোঃ আজমল হোসেন জিতু
সদস্য,
সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি,
জাতীয় পার্টি।
১৪ জুলাই ২০২৩