বরিশাল ব্যুরো ॥ বরিশাল সদর উপজেলার ২নং কাশিপুর ইউনিয়ন বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা ও আওয়ামী পন্থি ইউপি সচিবের গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন সাবেক সচিব আবুল হোসেন হাওলাদারের ভাই কাশিপুর চৌমাথা বাজার কমিটির সভাপতি বিএনপি নেতা মো. দেলোয়ার হোসেনসহ দলের মোট চার নেতা। ইউনিয়ন বিএনপির আহ্বায়ক মো. আলী আহম্মেদ মিয়া ও সদস্য সচিব মো. হুমায়ুন কবির ওয়াসিম সহ ইউপি সচিব মো. আব্দুল করিম ভিজিএফ এর বরাদ্দকৃত ৪ মেট্রিক টন চালের ৪’শ কার্ড আত্মসাৎ করতে গিয়ে স্থানীয় জনতার হাতেনাতে ধরা পরে। বিষয়টি সম্পর্কে সোমবার (১৭ মার্চ) বেলা বারোটায় স্থানীয় গণ্যমান্য প্রায় এক ডজন মানুষ সদর উপজেলা নির্বাহী কার্যালয়, সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিস ও বরিশাল জেলা প্রশাসক ও ছাত্র প্রতিনিধিদেরকে অবহিত করেন। এমন পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) বরিশাল সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদের ভিজিএফ এর বরাদ্দকৃত সকল চালের কার্ড বাজেয়াপ্ত করেছেন এবং পরবর্তীতে নতুন করে কার্ড বরাদ্দ দেয়া হবে বলে জানিয়েছে ইউপি সচিব মো. আব্দুল করিম।
ইউনিয়ন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক প্রবীণ নেতা আব্দুল হক সিকদার বলেন, আসন্ন পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে সরকার কর্তৃক কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদে অসহায় গরিবদের মাঝে ১৪ মেট্রিকটন ভিজিএফ চাল বরাদ্দ আসে। ১৪শ ৩০টি কার্ডের মাধ্যমে চালগুলো দুস্থদের মাঝে বিতরণ করা হবে। এ লক্ষ্যে আওয়ামী পন্থী ইউপি সচিব মো. আঃ করিম চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের নাম উল্লেখ করে একটি রেজুলেশন তৈরি করে। রেজুলেশনের ১৪ ও ১৫ নং সিরিয়ালে রয়েছে- কাশিপুর ইউনিয়ন বিএনপির আহবায়ক আলী আহম্মেদ মিয়া ও সদস্য সচিব হুমায়ুন কবির ওয়াসিমের নাম এবং স্বাক্ষর। এক নম্বরে কাশিপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো. কামাল হোসেন লিটন মোল্লার নাম থাকলেও তার স্বাক্ষর নেই। একইভাবে নাম থাকলেও স্বাক্ষর নেই মেম্বার মো. সুমন মীর, মো. রাসেল মল্লিক ও মো. আতিকুর রহমান সহ কয়েকজনের। যাদের স্বাক্ষর আছে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে অনেকে।
কাশিপুর ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মো. দেলোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন- শনিবার (১৫ মার্চ) সকাল ১১ টার সময় ইউনিয়ন পরিষদে আসি। গিয়ে দেখি ভিজিএফ কার্ড বিতরণের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তালিকার প্রথমেই চেয়ারম্যানের নামে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪’শ কার্ড। চেয়ারম্যান ৫ আগস্টের পর পলাতক থাকায় ইউপি সচিব মো. আঃ করিম কে প্রশ্ন করি- রেজুলেশনে চেয়ারম্যানের নামে বরাদ্দ রাখা ৪’শ কার্ডের অনুকূলে রাজন নামের এক ব্যক্তি স্বাক্ষর দিয়ে চেয়ারম্যানের কার্ড রিসিভ করেছে। এই রাজন কে? ইউপি সচিব সুউত্তর দেয়নি। পরে জানতে পারি স্থানীয় চেয়ারম্যান অনুসারী আওয়ামী দোসর ছাত্রলীগ নেতা রাজন। ফ্যাসিবাদীদের ভিজিএফ চালের কার্ড দিলেন? বিষয়টি জানাজানি হলে চাকুরি বাঁচাতে ইউপি সচিব ওই ৪’শ কার্ড এনে নিজের কাছে রাখেন।
দেলোয়ার আরো বলেন, রোববার (১৬ মার্চ) সকাল ১১ টায় ইউপি সচিব পরিষদে বসে উপস্থিত সাংবাদিকদের সামনে ওই ৪’শ কার্ড বিতরণের জন্য রেজুলেশন খাতায় আমার নাম লিখে সেখানে স্বাক্ষর নেয়। এবং সবাইকে নিয়ে নিয়ে বিতরণের অনুরোধ করে। বিকেলে সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) আমার মুঠোফোনে কল করে বলেন, আপনি একা ৪’শ কার্ড নিয়েছেন কেন? উত্তরে আমি পুরো ঘটনার বিষয়টি অবগত করে বলি- কার্ডগুলো আমাকে সবার মাঝে বিতরণ করার জন্য দেয়া হয়েছে। তিনি আমার কথা শুনে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে ঘটনার বিষয়টি জানানোর নির্দেশ দেন। সোমবার (১৭ মার্চ) বেলা ১২ টায় স্থানীয় গণ্যমান্য ১২/১৩ জনকে নিয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে যাই। নির্বাহী কর্মকর্তাকে না পেয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে বিষয়টি সর্ম্পকে অবগত করি। উপজেলা কার্যালয় থেকে চলে আসার পথে দেখতে পাই আলী আহম্মেদ মিয়া, ফরিদ উদ্দিন মোল্লা, হুমায়ুন কবির ওয়াসিম ও আব্দুল করিম একসাথে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে প্রবেশ করছেন।
দুইদিনের টানটান উত্তেজনা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় কিছু বাসিন্দা বিষয়টি ছাত্র সমাজকে জানায়। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলা আহ্বায়ক সাব্বির হোসেন সোহাগ ও মহানগর যুগ্ম সদস্য সচিব লাবণ্য আক্তার কে অবগত করলে তারা বিষয়টি নিয়ে বরিশাল জেলা প্রশাসক কে অবগত করেছেন বলে জানান। আবার কয়েক বাসিন্দা ঘটনাটি বরিশাল এয়ারপোর্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কে মৌখিকভাবে জানিয়েছেন।
কাশিপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি আবু তাহের খোকন মুন্সী বলেন- দীর্ঘ বছর ধরে ইউনিয়ন বিএনপির দায়িত্বে থাকা মো. আলী আহম্মেদ মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক (বর্তমান সদস্য সচিব) মো. হুমায়ুন কবির ওয়াসিম নানা অপকর্মে লিপ্ত ছিল এবং আ.লীগের সাথে উঠবস করত। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিগত উপজেলা নির্বাচনে প্রকাশ্যে এক আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেন যা সংগঠনের চরম নিয়ম পরিপন্থি। অপরদিকে বিএনপির কেন্দ্র থেকে নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়া এবং অংশগ্রহণ না করার নির্দেশ থাকলেও কাশিপুর ইউপি নির্বাচনে মেম্বার পদে অংশ নিয়েছিল আলী আহম্মেদ মিয়ার আপন ভাইয়ের ছেলে মো. জাকির হোসেন, ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি আরিফুর রহমান ফারুক তালুকদার, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি কবির আহমেদ পোষার ছেলে ও সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সানাউল কবির রেজভী এবং সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী এমদাদ হোসেন। এরা সকলেই আ.লীগের সাথে আঁতাত করে সক্রিয় ভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। আবার তাদেরকে নিয়েই কাশিপুর ইউনিয়ন বিএনপির কমিটি গঠন হওয়ায় ভিজিএফ সহ নানা বরাদ্দকৃত প্রকল্পে এমন ঘটনা ঘটেই চলেছে। যা বেশির ভাগ প্রকাশ্যে আসে না।
এদিকে এ ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে তৃণমূল বিএনপির নেতাকর্মীরা। ইউনিয়নের বিএনপি ওয়ার্ড বিএনপির নেতাকর্মী সহ সাধারণ মানুষ বলেন আলী আহমেদ ও হুমায়ূন কবির ওয়াসিম স্বাক্ষরিত রেজুলেশনে ফ্যাসিস্টের দোসর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক চেয়ারম্যানের নামে কি করে ৪’ কার্ড বরাদ্দ রাখা হয়েছে? সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কর্মকর্তারা ইউপি সচিবের কাছে জিজ্ঞেস না করে বরং উল্টো আত্মসাতকৃত উদ্ধার করা নেতৃবৃন্দকে ছিনতাইকারী আখ্যায়িত করে আত্মসাতকারীদের উৎসাহিত করছেন। প্রশাসনের এমন আচরণের তীব্র নিন্দা প্রতিবাদ জানান সাধারণ মানুষ সহ তৃণমূল বিএনপির নেতাকর্মীরা। পাশাপাশি দলের মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টাকারী দুষ্ট চরিত্রের ইউনিয়ন বিএনপির আহবায়ক আলী আহমেদ ও মহা বিতর্কিত হুমায়ুন কবির ওয়াসিমের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যাবস্থা নেয়ার জোড়ালো দাবি জানান তারা।
আওয়ামী ফ্যাসিস্টের দোসর ইউপি সচিব মো. আব্দুল করিম বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান মো. কামাল হোসেন লিটন মোল্লার নামের অনুকূলে আগে থেকেই ছাত্রলীগ নেতা রাজন সব সময় স্বাক্ষর দিয়ে অনুদানগুলো নিতো। সেই সুবাদে তাকে দেয়া হয়েছিল। পরে ইউএনও স্যারের নির্দেশে সব বাদ দিয়ে নতুন করে কার্ড করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এখানে কার্ড ছিনতাইয়ের কোনো ঘটনা ঘটেনি বলেও জানান তিনি।
কাশিপুর ইউনিয়ন বিএনপির আহ্বায়ক মো. আলী আহমেদ মিয়া বলেন, কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদের ভিজিএফ এর কার্ড বরাদ্দের বিষয় নিয়ে ইউপি সচিব আঃ করিম আমাকে ও সদস্য সচিব হুমায়ূন কবির ওয়াসিমকে ডাকে। আমরা দলমত নির্বিশেষে এলাকার দুস্থদের মাঝে কার্ড বিতরণের কথা বলি। পরে একপক্ষ এসে চেয়ারম্যানের এই ৪’শ কার্ড নিয়ে আলোচনা সমালোচনা শুরু করে।
কাশিপুর ইউনিয়ন বিএনপির সদস্য সচিব হুমায়ূন কবির ওয়াসিম বলেন, চেয়ারম্যানের ৪’শ কার্ড নিয়ে এলোমেলো পরিস্থিতির সৃস্টি হয়েছিল। এখন সব কার্ড বাতিল করা হয়েছে নতুন করে কার্ড দেয়া হবে।