বঙ্গ নিউজ বিডি ডেস্ক : বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার দুই মাস পেরিয়ে গেলেও এর প্রভাব পড়েনি কৃষি মন্ত্রণালয়ে। সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক একটি মামলায় গ্রেফতার হলেও তার সাজানো প্রশাসনেই চলছে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব কর্মকর্তা দফতরে বসে বর্তমান সরকারকে ব্যর্থ করার জন্য নানামুখী ষড়যন্ত্র করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। বিশেষায়িত এই মন্ত্রণালয়ে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত না নিলে ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত কর্মকর্তা ছিলেন বাকৃবির সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী ওয়াহিদা আকতার। ১৩তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের এই কর্মকর্তা প্রায় চার বছর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সচিব (পিএস) ছিলেন। এরপর কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন), পদোন্নতি পেয়ে একই মন্ত্রণালয়ের সচিব হন। অবসরে যাওয়ার পর দলীয় কোটায় চুক্তিতে নিয়োগ পান। গত ৪ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগের দিন তিনি খামারবাড়িতে সারা দেশ থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়ভুক্ত কৃষিবিদ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের রাস্তায় নামান ছাত্র-জনতার বিপক্ষে। স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর ওয়াহিদা আক্তারের চুক্তি বাতিল করলেও তার সাজানো প্রশাসনের প্রায় সবাই রয়েছেন বহাল তবিয়তে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওয়াহিদা আক্তারের চুক্তি বাতিলের পর এই মন্ত্রণালয়ে সচিব হিসেবে নিয়োগ পান তারই ব্যাচমেট ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান। প্রশাসন ক্যাডারের ১১ ব্যাচের এই কর্মকর্তা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সমন্বয়ক ছিলেন। এই কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন সাবেক মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। সুনির্দিষ্ট মামলায় যাকে গত ২ অক্টোবর গ্রেফতার করে পুলিশ। এই দিবস উদযাপনের নামে দেশের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রায় ২০০ কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ ওঠে। আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতায় আসার পর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, আইএমইডির মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতরে কাজ করেন এই কর্মকর্তা।
মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তা জানান, সরকারের সুবিধাভোগী এই সচিব তার অধিনস্ত আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তাদের বিভিন্নভাবে আগলে রেখেছেন। গত ৯ অক্টোবর মন্ত্রণালয়ের আওয়ামীপন্থী অতিরিক্ত সচিব ড. মলয় চৌধুরীকে ওএসডি করে সরকার। এর ১১ দিন অতিবাহিত হলেও সচিব তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাকে অফিস করাচ্ছেন। অতিরিক্ত সচিব ড. নুরুন্নাহার চৌধুরীকে গত ১৪ অক্টোবর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে অতিরিক্ত মহাপরিচালক পদে বদলি করে সরকার। এই কর্মকর্তাকে এখনো রিলিজ না দিয়ে মন্ত্রণালয়ে অফিস করাচ্ছেন সচিব। আওয়ামী সরকারের প্রভাবশালী সচিব আবু আলম শহীদ খানের সাবেক একান্ত সচিব রেহানা ইয়াসমিন রয়েছেন বহাল তবিয়তে।
ওয়াহিদা আক্তারের একান্ত সচিব (উপসচিব) নাহিদা বারিক এখনো কৃষি মন্ত্রণালয়েই বহাল রয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দেয়া এই কর্মকর্তা এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিলেন যে, অনেক অতিরিক্ত ও যুগ্ম সচিবও তার কাছে পাত্তা পেতেন না। আর মাঠের কৃষি কর্মকর্তারা বিশেষ করে ডিজি, প্রশাসন উইং ও প্রকল্প পরিচালকরা তাকে ম্যানেজেই ব্যস্ত থাকতেন। সাবেক এই ছাত্রলীগ নেত্রী কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন উইংয়ের আইন শাখার উপসচিব এখন। আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী নীলফামারী ও মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক ছিলেন নাজিয়া শিরিন। বালুমহালের ইজারার টাকা সংক্রান্ত দুর্নীতির বিভাগীয় মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হন এই কর্মকর্তা। এরপর ছাত্রলীগের এই নেত্রী রাষ্ট্রপতির নিকট দণ্ড মওকুফের আবেদন করলে দলীয় বিবেচনায় রাষ্ট্রপতি তার দণ্ড মওকুফ করেন। যুগ্ম সচিব হিসেবে পদোন্নতিও পান তিনি। সচিবের ছত্রছায়ায় থেকে এই কর্মকর্তা তার রুমে বসে আওয়ামী পন্থী কর্মকর্তাদের নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নানা সমালোচনা করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের।
মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পদমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তা বলেন, আওয়ামী সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট কয়েকজন সাবেক জেলা প্রশাসক এখনো বহাল তবিয়তে এই মন্ত্রণালয়ে থেকে সরকার বিরোধী প্রপাগান্ড চালাচ্ছেন। এর মধ্যে রয়েছেন যুগ্ম সচিব ও ময়মনসিংহের সাবেক জেলা প্রশাসক মোহাম্মাদ এনামুল হক, যুগ্ম সচিব ও পঞ্চগড়ের সাবেক জেলা প্রশাসক ড. সাবিনা ইয়াসমিন, উপসচিব ও হবিগঞ্জের সাবেক জেলা প্রশাসক দেবী চন্দ। এ ছাড়াও বিগত সরকারের নানাভাবে সুবিধাভোগী যুগ্ম সচিব দীপংকর বিশ্বাস, উপসচিব শেখ হাফিজুর রহমান, জসিম উদ্দিন, মোহাম্মদ জহিরুল ইসলামসহ অনেকেই রয়েছেন বহাল তবিয়তে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, শুধু মন্ত্রণালয় নয়, কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধিনস্থ বিভিন্ন অধিদফতর/সংস্থা/প্রতিষ্ঠানের কোনো কোনো মহাপরিচালক বা পরিচালকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে এখনো বহাল রয়েছেন বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সুবিধাভোগীরা। যারা ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ানের ছাত্রছায়া থেকে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। বিশেষায়িত এই মন্ত্রণালয়টি বিভিন্ন সময়ে উৎপাদন বাড়াতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এতে গড়িমসি করলে উৎপাদনের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
এ বিষয়ে কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ানের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার সাথে সাক্ষাৎ করা সম্ভব হয়নি।