দুই.
গবেষণায় সাব্যস্ত হয়েছে যে, যে বিয়েগুলো ছেলে-মেয়ের পূর্ব প্রেমের ভিত্তিতে সম্পন্ন হয় সে বিয়েগুলোর অধিকাংশই ব্যর্থ। পক্ষান্তরে, যে বিয়েগুলো এ ধরণের হারাম সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে না বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সে বিয়েগুলো সফল; যেগুলোকে মানুষ “গতানুগতিক বিয়ে” নামে অভিহিত করে থাকে।
ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী সৌল-জুর-ডন এর মাঠ পর্যায়ের একটি গবেষণার ফলাফল হচ্ছে- “যে বিয়ের পাত্র-পাত্রী বিয়ের আগে প্রেমে পড়েনি এমন বিয়ে তুলনামূলকভাবে বড় সফলতা বাস্তবায়ন করছে।”
অপর এক সমাজবিজ্ঞানী ‘আব্দুল বারী’ কর্তৃক ১৫০০ টি পরিবারের ওপর পরিচালিত গবেষণার ফলাফল হচ্ছে- ৭৫ শতাংশের বেশি প্রেমঘটিত বিয়ে তালাকের মাধ্যমে পরিসমাপ্ত হয়েছে। পক্ষান্তরে, গতানুগতিক বিয়ের ক্ষেত্রে, তথা পূর্ব-প্রেমঘটিত নয় এমন বিয়েগুলোর ক্ষেত্রে এর শতাংশ ৫ শতাংশের নীচে।
এ ফলাফলের পেছনে প্রধান যে কারণগুলো থাকতে পারে সেগুলো হচ্ছে-
১. আবেগের তাড়নায় দোষ-ত্রুটি দেখা ও যাচাইবাছাই করার ক্ষেত্রে অন্ধ হয়ে থাকা। যেমনটি বলা হয়- وعين الرضا عن كل عيب كليلة (ভক্তির চোখ দোষ দেখার ক্ষেত্রে অন্ধ)। হতে পারে পাত্র-পাত্রী দুইজনের একজনের মাঝে কিংবা উভয় জনের মাঝে এমন কিছু দোষ রয়েছে যেগুলোর কারণে তিনি অপর পক্ষের উপযুক্ত নন। কিন্তু, এ দোষগুলো বিয়ের পরে ফুটে উঠে।
২. প্রেমিক ও প্রেমিকা উভয়ে ধারণা করেন যে, জীবন হচ্ছে— একটি ‘লাভ জার্নি’; যার কোনো অন্ত নেই। এ কারণে আমরা দেখি যে, তারা ভালবাসা ও ভবিষ্যৎ-স্বপ্ন ইত্যাদি ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে কথা বলে না। পক্ষান্তরে, জীবন ঘনিষ্ঠ নানাবিধ সমস্যা ও সেগুলোকে মোকাবিলা করার পদ্ধতি তাদের আলোচনায় স্থান পায় না। কিন্তু, তাদের এ ধারণা বিয়ের পর চুরমার হয়ে যায়। যখন তারা জীবনের নানা সমস্যা ও দায়-দায়িত্বের মুখোমুখি হয়।
৩. প্রেমিক-প্রেমিকা সাধারণত সংলাপ ও আলোচনায় অভ্যস্ত নয়। বরং তারা ত্যাগ ও অপর পক্ষকে সন্তুষ্ট করার জন্য স্ব-ইচ্ছা বিসর্জন দেয়ায় অভ্যস্ত। বরং তাদের দু’জনের মাঝে তেমন কোনেি মতভেদ হয় না। কারণ প্রত্যেক পক্ষ অপর পক্ষকে সন্তুষ্ট করবার জন্য ছাড় দিতে প্রস্তুত! কিন্তু, বিয়ের পরের অবস্থাটি এর সম্পূর্ণ বিপরীত। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের আলোচনা সমস্যার রূপ ধারণ করে। কেননা তাদের দুজনের প্রত্যেকে কোনো প্রকার আলোচনা-পর্যালোচনা ব্যতিরেকে স্বীয় মতের প্রতি অপর পক্ষের সম্মতি পেয়ে অভ্যস্ত।
৪. প্রেমিক-প্রেমিকা একে অপরের কাছে নিজের যে চরিত্র ফুটিয়ে তোলে সেটা তার আসল চরিত্র নয়। প্রেমকালীন সময়ে দুই পক্ষের প্রত্যেক পক্ষ অপর পক্ষকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য কোমলতা, নম্রতা ও আত্মত্যাগের চরিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু, তার পক্ষে এ চরিত্রের ওপর আজীবন অবিচল থাকা সম্ভবপর হয় না। তাই বিয়ের পর তার আসল চরিত্র ফুটে উঠে। আর সেই সাথে সমস্যাগুলো শুরু হয়।
৫. প্রেমকালীন সময়টা অধিকাংশ ক্ষেত্রে রঙিন সব স্বপ্ন ও অতিরঞ্জন ভিত্তিক হয়ে থাকে; যার সাথে বিয়ের পরের বাস্তবতার মিল থাকে না। প্রেমিক তাকে প্রতিশ্রুতি দেয় যে, শীঘ্রই সে তার জন্য চাঁদের টুকরা হাযির করবে, তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী নারী না করে স্বস্তি পাবে না…ইত্যাদি। বিপরীত দিকে প্রেমিকা বলে— সে যদি তাকে পায় তাহলে তার সাথে একটা রুমেই থাকতে পারবে, ফ্লোরে ঘুমাতে পারবে, তার কোন চাওয়া-পাওয়া নাই, তাকে পেলেই চলবে!! যেমন জনৈক ব্যক্তি প্রেমিক-প্রেমিকাদের উক্তি উদ্ধৃত করতে গিয়ে বলেছেন: “عش العصفورة يكفينا” ، و “لقمة صغيرة تكفينا” “أطعمني جبنة وزيتونة” (চড়ুই পাখির বাসা ও ছোট্ট এক লোকমা খাবার আমাদের জন্য যথেষ্ট। এক টুকরা চিজ ও একটি যাইতুন পেলেই আমি সন্তুষ্ট।) এসব আবেগ তাড়িত ও অতিরঞ্জিত কথা। সে জন্য উভয় পক্ষ অতিদ্রুত এ কথাগুলো ভুলে যায় কিংবা বিয়ের পর ভুলে যাওয়ার ভান ধরে। বিয়ের পর স্ত্রী স্বামীর কৃপণতা ও তার ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ না করার অভিযোগ করে। আর স্বামী স্ত্রীর ব্যাপক চাহিদা ও প্রচুর খরচের অভিযোগ করে।
উল্লেখিত কারণগুলো ও আরও অন্যান্য কারণে বিয়ের পরে উভয় পক্ষ কোনো রাখঢাক ছাড়াই বলে যে, সে প্রতারিত হয়েছে, সে খুব তাড়াহুড়া করে ফেলেছে। পুরুষ লোকটা এই ভেবে আফসোস করে যে, তার বাবা তার জন্য যে মেয়েটি ঠিক করেছিল সে ঐ মেয়েটিকে বিয়ে করল না কেন। আর মেয়ে লোকটি এই ভেবে আফসোস করে যে, তার পরিবার তার জন্য যে ছেলেটি ঠিক করেছিল সে ঐ ছেলেটিকে বিয়ে করল না কেন; অথচ পরিবার তো তাকে তার ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার উপর ছেড়ে দিয়েছিল!
ফলাফল হল- যে বিয়েগুলোর পক্ষদ্বয় ভাবত যে, অচিরেই তারা হবে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী দম্পতির উদাহরণ তাদের মাঝে তালাকের শতাংশ এত বেশি সংখ্যায়!!
তিন.
উল্লেখিত কারণগুলো— ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও দৃশ্যমান; যেগুলোর সত্যতার পক্ষে সাক্ষী দেয় বাস্তবতা। কিন্তু আমাদের উচিত হবে না, এ বিয়েগুলো ব্যর্থ হওয়ার প্রধান যে কারণ সেটাকে এড়িয়ে যাওয়া। সে কারণটি হচ্ছে— এ ধরণের বিয়েগুলোর ভিত্তিপ্রস্তর আল্লাহ্র অবাধ্যতার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলাম এ ধরণের পাপময় সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিতে পারে না; এমনকি সেটা যদি বিয়ের উদ্দেশ্যে হয় তবুও। তাই এ ধরণের বিবাহে আবদ্ধ দম্পতিদের ওপর আসমানী শাস্তি আসেই আসে।
আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “যে ব্যক্তি আমার যিকির থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তার জন্য রয়েছে কষ্টের জীবন”।[সূরা ত্বহা, আয়াত: ১২৪] কঠিন ও কষ্টদায়ক জীবন আল্লাহ্র অবাধ্যতা ও তাঁর ওহি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার প্রতিফল।
আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেন: “আর যদি গ্রামবাসীরা ঈমান আনত ও তাকওয়া অবলম্বন করত তাহলে অবশ্যই আমি তাদের জন্য আসমান ও জমিনের বরকতসমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম।”[সূরা আরাফ, আয়াত: ৯৬] আল্লাহ্র পক্ষ থেকে বরকত হচ্ছে ঈমান ও তাকওয়ার প্রতিদান। যদি ঈমান ও তাকওয়া না থাকে কিংবা কম থাকে তাহলে বরকত কমে যায় কিংবা একেবারে নাই হয়ে যায়।
আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেন: “যে পুরুষ বা নারী ঈমানদার অবস্থায় সৎকাজ করবে তাকে আমি উত্তম জীবন দান করব এবং অবশ্যই তাদেরকে তাদের শ্রেষ্ঠ কাজের পুরস্কার দিব।” [সূরা নাহল, আয়াত: ৯৭] অতএব, উত্তম জীবন হচ্ছে— ঈমান ও নেক আমলের প্রতিফল।
আল্লাহ্ তাআলা সত্য বলেছেন যে, “অতএব যে লোক আল্লাহ্র ভয় ও সন্তুষ্টির উপর স্বীয় ভবনের ভিত্তি স্থাপন করে সে কি ভাল, না যে পড়পড় এক ভাঙ্গনের কিনারায় তার ভবনের ভিত্তি স্থাপন করে আর এই ভবন তাকে নিয়ে জাহান্নামের আগুনে ভেঙ্গে পড়ে সে ভাল? আল্লাহ্ জালিমদেরকে হেদায়েত করেন না।”[সূরা তাওবা, আয়াত: ১০৯]
অতএব, যে ব্যক্তির বিবাহ এমন হারাম ভিত্তির ওপর গড়ে উঠেছে তার উচিত অবিলম্বে তওবা ও ইস্তিগফার করা। নতুনভাবে পুণ্যময় জীবন শুরু করা। যে জীবনের ভিত্তি হবে ঈমান ও নেক আমল।
মহান আল্লাহই তার পছন্দনীয় ও সন্তোষমূলক আমলের তাওফিকদাতা।